একটি আগুনের শিখা যেমন একটি ঘরের মধ্যে সবকিছু পুড়িয়ে ফেলতে পারে তেমনই যোগীর হৃদয়ে অবস্থিত ভগবান শ্রীবিষ্ণু তার অন্তর থেকে সব রকমের কলুষতা দহন করেন। যোগসূত্রেও ধ্যানের প্রণালী বর্ণনা করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে ভগবান শ্রীবিষ্ণুকে ধ্যান করতে। শূন্যকে ধ্যান করার কথা বলা হয় নি। যে সমস্ত তথাকথিত যোগী শ্রীবিষ্ণু ছাড়া অন্যকিছুর ধ্যান করে, তারা কোন অলীক ছায়ামূর্তির দর্শন করার আশায় অনর্থক সময় নষ্ট করে থাকে। কিন্তু যারা পরমার্থ সাধনে প্রয়াসী তারা কেবল ভগবদ্ভক্তিরই আকাঙ্ক্ষা করেন—- সর্বতোভাবে ভগবানের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করেন। এটিই হচ্ছে যোগীর প্রকৃত উদ্দেশ্য।
মানব জীবনে যোগের এর গুরুত্ব
সুপ্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের যোগী ঋষিরা উপলব্ধি করে আসছেন যে আমাদের জীবনে অর্থাৎ দেহ-মন ও আত্মার বিকাশে বিভিন্ন আসনের সদর্থক ভূমিকা রয়েছে৷ ‘আসন’ কী ? আসন হ’ল আরামদায়ক দেহ ভঙ্গিমা যার মাধ্যমে দেহ ও মনের বিশ্রাম হয়, আসন আমাদের দেহস্থ অন্তক্ষরা গ্রন্থিগুলি ওপর বিশেষ পদ্ধতিতে চাপ সৃষ্টি ও চাপ বিমোচনের মাধ্যমে তাদেরকে সুস্থ ও সক্রিয় করে তোলে৷ এতে করে গ্রন্থিরস (হরমোন) নি:সরণ সন্তুলিত হয়ে শরীরের সর্র্বঙ্গ সুস্থ ব্যধিমুক্ত হয়৷ প্রাণশক্তি বৃদ্ধি করে৷ গ্রন্থিগুলির হরমোন ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে মনের ভয়, উদ্বেগ, ক্রোধ অস্থিরতা মোহ প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করে৷ মানসিক চাপথেকে মনকে মুক্ত করে ধৈর্য্য ও সামর্থ্য বাড়ায়, মনকে প্রশান্ত রাখে৷
অন্যদিকে, বিভিন্ন কু-অভ্যাস আহারগত ত্রুটি প্রভৃতি নানা কারণে দেহস্থ গ্রন্থিগুলি তথা অরগানগুলি দুর্বল হয়ে পড়লে হরমোন নিঃসরণের ভারসাম্য নষ্ট হয় ও তার ফলে নানান মানসিক চাপ ও ঋণাত্মক প্রবৃত্তি জেগে ওঠে যা ক্রমান্বয়ে দেহে স্থায়ী হতে হতে নানান ব্যাধির জন্ম দেয়৷ শরীর হয়ে ওঠে ‘ব্যাধি মন্দিরম্’৷ চিকিৎসকরা বলেন যে, আমাদের দেহে অধিকাংশ ব্যাধি হল সাইকোসোমটিক্ (psycho-somatic) অর্থাৎ দেহস্থ ব্যাধির সাথে মনের নিবীড় যোগসূত্র আছে৷
মনের প্রসুপ্ত ব্যাধিই ক্রমান্বয়ে দেহে আত্মপ্রকাশ করে ও শরীরকে ক্ষয়ের দিকে নিয়ে যায়৷ বিভিন্ন ঋণাত্মক মানসিক বৃত্তি ও চাপ উদ্ভূত মারাত্মক ব্যাধিগুলির সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত৷ মানসিক পীড়া, অস্থিরতা, কিংবা ‘চাপা যন্ত্রণা’ থেকে আমাদের দেহের পেশী ও স্নায়ুকোষগুলি দুর্বল হয়ে যায়৷ ফলে স্নায়ুর যন্ত্রণা, দুর্বলতা, অবসাদ প্রভৃতি সৃষ্টি হয়৷ থাইমাসগ্রন্থি দুর্বল হলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ক্যানসারের কোষ বৃদ্ধি পেতে পারে৷ থাইরয়েডের ক্রুটির ফলে গ্যাসজনিত সম্যসা, আলসার, ডায়াবেটিস হতে পারে ৷ ‘ক্রোধ, ধৈর্যহীনতা মানসিক চাপ থেকে হৃদরোগ হবার সম্ভাবনা প্রবল৷
খাদ্যবিধির সম্পর্কে একটু সচেতন হয়ে বিশেষ কিছু আসন নিয়মিত অভ্যাস করলে সুস্থজীবন লাভ করা যায়৷ কিন্তু কী কী আসন দেহস্থ গ্রন্থি ও অরগান গুলিকে সুস্থ ও সক্রিয় রাখে ও কীভাবে তা অভ্যাস করতে হবে এব্যাপারে সদ্গুরু বা উপযুক্ত আচার্যের নির্দেশনা অত্যাবশ্যক৷ বিভিন্ন জনের দেহের ও মনের গঠন ও তাদের সমস্যার কথা শুণে সদগুরুর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আচার্য বা আচার্যারা আগ্রহীদের আসনবিধি শিখিয়ে দেন৷
ভগবদ গীতা অনুসারে যোগের বিভিন্ন রূপ :
‘শ্রীমদ্ভাগবতগীতা’-তে শ্রীকৃষ্ণ যোগের সংজ্ঞা বলছেন—‘‘যোগঃ কর্মসু কৌশলম্’’ অর্থাৎ কর্মের কৌশলই যোগ৷ প্রতিমুহূর্তেই আমরা কর্ম করে চলেছি৷ এই কর্ম করার মাধ্যমেই জীবন পথে এগিয়ে চলেছি৷ এই চলার মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট ছন্দ বা কৌশল, যেমন রং, তুলি, কাগজ, থাকলেই ছবি আঁকা যায় না৷ ছবির আঁকার কৌশল আয়ত্তে আনা চাই৷ এই কৌশলকে যে যত ভালভাবে আয়ত্তে আনতে পারবে, সে তত বড়ো শিল্পী, তত বড় যোগী৷
যুক্তির খাতিরে আমরা উপলদ্বি করেছি যে, জীবনের পরম আরাধ্য (ধ্যেয়) হলেন — চৈতন্যময় ব্রহ্ম৷ তাঁকে পাবার এষণাই জীবনের মৌলিক ধর্ম তথা মানবধর্ম৷ বিষয় ভোগে আসক্ত মনকে ব্রহ্মের অভিমুখে নিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন৷ জানতে হবে ধর্ম সাধনার উপযুক্ত কৌশল৷ সাধনার কৌশল যে যত ভালভাবে রপ্ত করতে পারবে সে ততই ব্রহ্মের নিকটে পৌঁছে যাবে৷ সাধনার এই কৌশলই ধর্ম-বিজ্ঞানে ‘যোগ’ নামে পরিচিত ৷ ‘যোগ’ শব্দের দু’রকমের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়৷ —
•‘যুজ্’+ ঘঞ্ প্রত্যয়= যোগ ৷ এই ‘যুজ্’ শব্দের অর্থ— সংযোজন করা to add) যেমন ১+১= ২ — এখানে ১ এর সাথে ১ সংযোজন করলে ‘দুই’ হবে৷ পাটিগণিতে এই ‘যোগ’-এর কথাই বলা হয়৷
•