‘মেঘনাদবধ কাব্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য প্রভাব কেমনভাবে প্রতিফলিত তা আলোচনা করো।

ভূমিকাঃ বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক মহাকাব্য রচয়িতা মাইকেল মুসূদন দত্ত ( ১৮২৪-১৮৭৩ ) । তাঁর রচিত ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ ( ১৮৬১ ) বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দেয় । বলা হয় এ কাব্য রচনার মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটে । গঠন রীতির দিক নিয়ে এ মহাকাব্য বাংলা কাব্য ইতিহাসে অভিনব এবং অনন্য । শুধু ইতিহাসের দিক থেকে নয় ,  আখ্যানভাগের রসাস্বাদনের দিক থেকেও এর মূল্য অনেক। গঠন রীতির  নৈপুণ্য এ কাব্যকে বিশিষ্টতা দান করেছে। নিম্নে মেঘনাদবধ কাব্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রভাব এবং ট্র্যাজেডি বিচার তুলে ধরা হলো:

মূলপর্ব : ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র গঠনরীতিতে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিভিন্ন কবিদের গঠনভাব সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন । তিনি পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য মহাকাব্য থেকে যে জ্ঞানলাভ করেছেন তা ‘মেঘনাদবধ কাব্য’তে প্রয়োগ করেছেন মেঘনাদবধ কাব্যে’র গঠন একটু জটিল । এজন্য কবি নিজেই বলেছেন, ” I think , I have constructed the poem on the most rigid principles and even a French critic would not find fault with me”. 

কাব্যের পরিধি ও কেন্দ্র প্রথম থেকেই স্থির করে ৯ টি সর্গে বিভক্ত করেছেন এবং প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মূল কাহিনীর গতিধাৱা যেভাবে অব্যাহত রেখেছেন তাতেই কাব্যখানির গঠনশৈলী সার্থক হয়ে উঠেছে । কাব্যে কবি মোট তিন দিন ও দুই রাএির পরিসরে আমাদের শুধু স্বর্গ – মর্ত্য – পাতাল পরিভ্রমণ করাননি সাথে সাথে তিনি লঙ্কা কাণ্ডের সামাজিক ধবংস যজ্ঞের ঘটনাও তুলে ধরেছেন।

কাব্যের গঠন শৈলীতে মধুসূদন দত্ত সচেতনভাবে অনুসরণ করেছেন , বহুলাংশে আত্মস্থ করেছেন । এমনকি কাব্যারম্ভের ” Let us begin , goddess of song ” এবং কাব্য সমাপ্তিতে হেক্টরের মৃতদেহ সৎকারান্তে স্তম্ভ নির্মাণ মধুসূদনের  মেঘনাদবধ কাব্যে স্পষ্টই অনুসৃত হয়েছে । মধুসূদনের বিশিষ্ট সাহিত্যিক রুচি এবং ইউরোপীয় কাব্য , নাটকাদি পঠন পাঠনের ফলেই গল্পগ্রহণে পাশ্চাত্য আদর্শের প্রতি তার শ্রদ্ধা জন্মে এবং তাদের অনুরূপ কাহিনী কাব্য লিখবার উদ্দেশ্যে তিনি হোমারকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন । বাংলা কাহিনী কাব্যের ইতিহাসে মধুসূদনের এ অভিনব পথপ্রদর্শন পরবর্তী উপন্যাস সাহিত্যকে কাহিনী গ্রন্থনে সহায়তা করেছিল ।

মধুসূদন ব্যক্তিজীবনে শক্তির উল্লাস যতই অনুভব করুন না কেন , এর সাথে শক্তির সীমিত রূপও উপলব্দি করেছেন । প্রচন্ড শক্তিবলে , সমস্ত জীবনব্যাপী তিনি আত্মপ্রতিষ্ঠার যে প্রাণপন প্রয়াস করেছেন তা আদৌ সার্থক হয়নি । এক বিরুদ্ধ শক্তির কাছে তাকে হার মানতে হয়েছে । বলা হয়েছে , মধুসূদনের ব্যক্তিজীবনের ব্যর্থতাই তাঁকে মানব জীবনের ট্র্যাজেডি সম্পর্কে কৌতুহলী করে তুলেছে । তাঁর এই সন্ধান – পরায়ণ ও অনুসন্ধিৎসু মূলত গ্রীক সাহিত্যে ও গ্রীক ট্র্যাজেডিতে লালিত হয়েছে , একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় । তিনি কবি জীবনে গ্রীক সাহিত্যের দ্বারা সব চাইতে বেশি প্রভাবান্বিত হয়েছেন । তাই তাঁর কাব্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রভাব বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করা যায়।

আদি কবি হোমার মধুসূদনের প্রিয় কবি । হোমারের মহাকাব্যে যুদ্ধের ঘনঘটা ও বীরত্বের হুংকার যতই থাকুক না কেন , এ সমস্ত উপরিভাগে ; এর অন্তরালে দেখা যায় মানুষে মানুষে সংগ্রামের কি নিদারুণ ব্যর্থতা !  গ্রীক ট্র্যাজেডি রচয়িতাদের ঈঙ্কিলাস , সোফোক্লিস , ইউরিপিদে — মধ্যে মানব জীবনের নিদারূণ দুঃখভোগই দেদীপ্যমান হয়ে উঠেছে।

গ্রীক ট্র্যাজেডিতে মানব – জীবনের বিষাদ – করুণ দিকটি মধুসূদনকে আচ্ছন্ন করে । তাই তিনি মানব – জীবনে শক্তির মহিমা যতই কীর্তন করুন না কেন , অপর এক বিরুদ্ধ শক্তির প্রভাবও তাঁকে স্বীকার করতে হয়েছে । ‘ মেঘনাদবধ কাব্যে রাবণ শক্তির আস্ফালনে যতই উন্মত্ত হোক না কেন , তার শক্তি দুয়ে ভাগ্যের কাছে এক অর্থে অর্থহীন হয়ে পড়েছে । তাই এ কাব্যে রাবণের বীরমূর্তি অপেক্ষা তার এক শোকাতর , বেদনাবিধুর মূর্তিই প্রকটিত হয়ে উঠেছে । এ কাব্যের আরম্ভ বিষাদে , পরিণতি বিয়োগ – বেদনায় । সর্গের পর সর্গে এই বিষাদই ঘনীভূত হয়ে পরিশেষে এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে দুই শিল্পসৃষ্টিতে , বিশেষত আখ্যান পরিকল্পনা ও বিন্যাসের দিক থেকে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ অনবদ্য । 

মেঘনাদের মৃত্যুর পর লঙ্কাধিপতি রাবণ যখন সমুদ্রতীরে শ্মশানে পুত্র ও পুত্রবধূকে চির-শায়িত করে, তখন সে কাতরকণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠল:

সঁপি রাজ্যভার , পুত্র , তোমায় করিব

মহাযাত্রা । কিন্তু বিধি – বুঝিব কেমনে 

তার লীলা ? ভাঁড়াইলা সে সুখ আমারে।

রাবণের আর আশা করবার , ভরসা করার , বিশ্বাস করবার কিছুই রইল না । নিদারুণ বেদনায় তার জীবন এমনি ট্র্যাজিক হয়ে উঠেছে । মহৎ প্রাণের গভীর আবেগ থেকেই মাত্র ট্র্যাজেডি উৎসারিত হতে পারে । কেননা , যে ক্ষুদ্রপ্রাণ সে অত বড় ট্রাজিক বেদনাকে ধারণ করবে কি করে ! রাবণের অনুভূতি যেমন গভীর , তেমনি তীব্র । তাই স্নেহ – প্রীতি মায়া – মমতার পারবশ্য তাকে এমন কাতর করে তুলেছে । বীরবাহুর মৃত্যুতে সে আক্ষেপ করে বলেছে , 

“ যে হৃদয় মোহামদে মুগ্ধ কোমল সে ফুলসম”।

রাবণ ভালবেসেছে বলেই না তার হৃদয় এত কোমল , কাতর ! চিত্রাঙ্গদার অভিযোগের প্রত্যুত্তরে সে উক্তি করেছে : এক পুত্রশোকে তুমি আকুলা , ললনে , শত পুত্রশোকে বুক আমার ফাটিছে দিবানিশি !

শুধু শত পুত্রের বিয়োগ – বেদনা নয় , লঙ্কাপুরী ও লঙ্কাপুরবাসীর মহাসর্বনাশও তার অন্তর বিমথিত করে তুলেছে।

ভাবনা কুসুমনামসজ্জিত দীপাবলী – তেজে

উজ্জ্বলিত-নাট্যশালাসম রে আছিল

এ মোর সুন্দর পুরী ! 

কিন্তু একে একে শুকাইছে ফুল এবে , নিবিছে দেউটি ;

তবে কেন আর আমি থাকি নে এখানে ,

কার যে বাসনা বাস করিতে আঁধারে ? 

অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে এই বেদনা উৎসারিত হয়েছে । অনুভূতির তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতায় সে আপনাকে আপনি অতিক্রম করে গেছে এবং তার অতল – গভীর বেদনা ট্রাজিক – মহিমা লাভ করেছে ।

ট্র্যাজেডি দুঃখেরই রসরূপ । কেননা , এতে মানবাত্মার নিদারুণ বেদনাও সুকঠোর । পীড়নের চিত্র উদঘাটিত করা হয়ে থাকে , যার পরিণতি ঘটে নিয়োগ বা বিষাদে । তবু ট্র্যাজেডির এই দুঃখ মানুষকে আনন্দ দেয় । ট্র্যাজেডিতে দুঃখ আনন্দে , বিষাদ হর্ষে রূপান্তরিত হয় । এর হেতু কি ? ট্র্যাজেডিতে দেখা যায় যে , প্রচন্ড ধ্বংসের মধ্যেও ট্র্যাজিক চরিত্র সুগভীর আত্মপ্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসে অটুট থাকে । 

রাবণ যেন আমাদের এই কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় , মানুষ ধংস হতে পারে , কিন্তু পারবশ্য স্বীকার করতে পারে না । মানুষ পরাজিত হতে পারে , কিন্তু পরাজয় সত্ত্বেও তার আত্মা অপরাজেয় হয়ে সগৌরবে বিরাজ করতে পারে । রাবণের জীবন চূড়ান্ত ব্যর্থতার মধ্যেই সার্থক হয়ে উঠেছে । তার জীবনে এত বড় সর্বনাশ বলেই সে এতখানি শক্তির পরিচয় দিতে পেরেছে । সেই শক্তি আমাদের আশ্বস্ত করে , আমরা পুলকিত হই এবং জীবনের ঘনকৃঃ যবনিকা অপসারিত হয়ে , জীবন সুন্দর ও মধুর হয়ে আমাদের কাছে প্রতিভাত হয় । মধুসূদন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে সাহিত্যের আদলে মেঘনাদবধ কাব্যে মানব – জীবনের এই মহিমাই উদ্ঘাটিত করেছেন ।

যবনিকা : রেনেসাঁসের কবি মধুসূদন দত্ত তার বাংলা সাহিত্যের সার্থক মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ’ এর মাধ্যমে সনাতন প্রাচীন ধারার দেবদেবী আশ্রিত বীরত্ব গাঁথাকে মানবিক গুণাবলিতে গুণান্বিত করে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ সৃষ্টি করেছেন। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ মহাকাব্য পঠন পাঠকেরা চিরায়ত সঞ্জীবনী ভাষার ব্যবহারে ‘রাবণ’ চরিত্রের নতুন আঙ্গিকের রুপ আস্বাদন করতে পারে । মধুসূদনের সার্থকতা এই অলীক দর্শনের সনাতন চিন্তা-ধারাকে আধুনিক মানবিক চিন্তনে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধের এক অপরিসীম মানবীয় আখ্যান হাজির করেছেন পাঠক সমাবেশে।

আর্টিকেল’টি ভালো লাগলে আপনার ফেইসবুক টাইমলাইনে শেয়ার দিবেন। তাতে আপনি যেকোনো সময় আর্টিকেলটি খুঁজে পাবেন এবং আপনার বন্ধুরাও আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হবে।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Cost effective solutions for sans 10400 xa compliance. Saraswat bank co operative ltd. Top 5 best local builders merchants – fylde & wyre dm developments north west.