নূতন মঙ্গল-এর অভিধায় ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল
ইতিহাসবোধে সমৃদ্ধ হয়ে একজন সমাজসংবেদনশীল কবি যখন মঙ্গলকাব্য লেখেন তখন তাতে খুব স্বাভাবিকভাবেই নতুন জীবনবোধের পদধ্বনি শোনার আশা করা যায়। ভারতচন্দ্র এমনটাই চেয়েছিলেন। তাই তাঁর কাব্যমধ্যে বারংবার ঘোষিত হয়েছে ‘নূতন মঙ্গল’-এর বার্তা। শুধু বার্তা নয়, উদ্বেগও। স্রোতের প্রতিমুখে চলার উদ্বেগ। রাজসভাকবির রাজফরমায়েশ আর প্রচলিত সাহিত্যকর্মকে অঙ্গীকার করেও তার অসারত্ব প্রদর্শন অন্যতর এক প্রতিবাদী জীবনভাবনার সাহচর্যে কখনও কখনও উদ্বেগজনক হয়েছে বৈকি।
এক প্রতিবাদী জীবনভাবনার সাহচর্যে কখনও কখনও উদ্বেগজনক হয়েছে বৈকি।
আসলে সময়টাই এমন। মধ্যযুগের অন্তিম পর্বে তখন সন্ধিক্ষণের উন্মাদনা ও অস্পষ্টতা। তমসা আর উষার সেই ক্রমস্ফুট সময়-বলয়ে তখন একই সঙ্গে আবর্তিত হয়ে চলেছে অতীত-ঐতিহ্য আর অনাগত ঐতিহ্যের দ্বন্দ্ব—বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলতা। এমনই এক যুগসন্ধির প্রতিনিধি কবি তো শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক ভাবসাগরে ডুব দিয়ে থাকতে পারেন না। যুগের দাবিতেই তিনি অন্যপথে হাঁটবেন। দায়িত্ব নেবেন নবতম কোনো যুগ-রচনার স্বপ্ন দেখাতে তার পাঠকদের
চেয়ে যে হীনশক্তি মনে করে, মঙ্গলকাব্যের ভক্তিরতলে যে জাতির আত্মবিশ্বাস বিলীয়মান তাকে স্বপ্ন দেখতে শেখানো সত্যিই কঠিন। সেই কঠিন দায়িত্বকে সম্ভাব্য করে তুলতেই তাই ভারতচন্দ্র বেছে নিলেন সেই পুরোনো ফর্ম মঙ্গলকাব্যের। মঙ্গলকাব্য বাংলার নিজস্ব সম্পদ। এ-কাব্যের বিষয় ও চরিত্রে, সমাজজীবন চিত্রণে কিংবা আচার-বিশ্বাসের রূপায়ণে খাঁটি বঙ্গীয় সৌরভ। প্রতিবাদী কবি হয়েও বঙ্গীয় ভাব-ভাবনা বা ঐতিহ্যকে অস্বীকার করতে পারেন না তিনি—এ বোধ তাঁর ছিল। আবার এও বলা যায় তিনি অগ্রাহ্য করতে পারেন নি প্রবহমান জাতি-চরিত্রকে। অনগ্রসর বিজিত হিন্দু, তুর্কি পরাক্রমোত্তর রুদ্ধশ্বাস গ্রহব, আর্ত-সঙ্কুল বিপন্ন আর্থ-সামাজিক প্রতিবেশ তখন বাঙালি চরিত্রের নিয়মক। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গচেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে থাকা দৈব-নির্ভরতা, অদৃষ্টবাদ আর সংস্কারের বীজকে সমূলে উপড়ে ফেলার প্রতিস্পর্ধিতা কারো একার পক্ষে সম্ভব নয়, তবু ভারতচন্দ্রের কাব্যেই তার সূচনা হল।
এই অনিবার্যতাকে মেনেই ভারতচন্দ্র তাই মঙ্গলকাব্যের বহু প্রচলিত সংস্কারকে অমান্য করেননি। মঙ্গলকাব্যের বিষয় সংস্থাপন এবং নির্মাণশৈলীতে একটা নিজস্ব ছন্দ আছে। বিশেষ রকমের পুরাণ-অভিমুখিতা আছে। বিশেষ দেবতার পূজা-প্রতিষ্ঠায় স্বপ্নদর্শন থেকে চতুরাঙ্গিক খণ্ড বিভাজন পর্যন্ত সর্বত্র এই পুরাণ-অনুগামিতা। আবার লোক-জীবন- সম্ভূত বিবিধ চেতনাও এর মূলে ক্রিয়াশীল। লোক-ঐতিহ্য মেনে নিয়ে দেবদেবীর বন্দনা থেকে বিষয়বস্তুর বিবিধ বর্ণনা–যেমন নারীদের পতিনিন্দা, সমুদ্রযাত্রা, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন লোকসংস্কার, পাকপ্রণালী ইত্যাদিতে প্রবহমান লোকজীবনকেই অনুকরণ করেছে মঙ্গলকাব্য। আর এই সব কিছুর মূলে দৈব আদেশাহত কিংকর্তব্যবিমূঢ় একজন কবির বিশেষ কোনো গোষ্ঠীপোষিত দেবতা বা দেবীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনের ঐহিক বাসনা কাজ করেছে।
অন্নদামঙ্গল এই সব শর্ত মেনেই মঙ্গলকাবা। তবু এর কবি ব্যতিক্রমী। বহিরাঙ্গিক কাহিনীবিন্যাস থেকে অন্তরঙ্গ উপাদান-নির্বাচন—সব ব্যাপারেই মঙ্গলকবিদের ধারায় তিনি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, একক মঙ্গলকাব্যের চতুরাঙ্গিক কাঠামোকে তিনি ভাঙলেন নতুনভাবে। বন্দনা অংশ, গ্রন্থোৎপত্তির কারণ (‘গ্রন্থসূচনা’) ছাড়াও তাঁর কাব্যটি বিভক্ত হল তিনখণ্ডে – (ক) ‘অন্নদামঙ্গল’ অর্থাৎ দেবখণ্ড (খ) ‘কালিকামঙ্গল’ বা ‘বিদ্যাসুন্দর’ অর্থাৎ নরখশুকেন্দ্রিক লৌকিক আখ্যান এবং (গ) ‘অন্নপূর্ণামঙ্গল’ বা ‘মানসিংহ’ অর্থাৎ ঐতিহাসিক কাহিনী। এইভাবে পুরাণ, রোমান্টিক লোকগাথা এবং ইতিহাসের সহায়তায় প্রচলিত মঙ্গলকাব্যের ধারায় আবির্ভূত হয়েও কবি রচনা করলেন ‘নূতন মঙ্গল’। কাব্যটির তিনটি অংশ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র—পৃথক মর্যাদার অধিকারী। তবুও তিনটির মধ্যে কাহিনীর যোগসূত্রতায় একটা আত্মীয়তার বন্ধন রয়েছে। ‘গ্রন্থসূচনা’ অংশকেও সেই অন্তরঙ্গ আত্মীয়তায় সামিল করা যায় এবং যে বিষয়টি এর থেকে স্পষ্ট হয় তা হল, মঙ্গলকাব্যের প্রচলিত ধারায় আবির্ভূত হলেও ভারতচন্দ্রের কাব্যে দেবী নন, মুখ্য হল সমকাল, সমকালের মানবজীবন। অষ্টাদশ শতাব্দীর অস্থির রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রকৃত স্বরূপটি ফুটিয়ে তুলতেই তাঁর এহেন কাব্য-পরিকল্পনা।
‘গ্রন্থসূচনা’ অংশটি নির্ভেজাল সময়ের দলিল। নবাব আলিবর্দি-অধীনস্থ বঙ্গভূমির বর্ণি- আক্রান্ত রূপ এবং আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়-চিত্র এর বিষয়। যে বিপর্যয়ের মূলে ছিল একদিকে বহিরাক্রমণ অন্যদিকে দেশীয় অরাজকতার মিশ্র প্রভাব। আর তারই ফলে এ-কাব্যে বর্ণি প্রসঙ্গে দৈবী ভূমিকা এসেছে। মোগল সৈন্য উড়িষ্যা প্রদেশে অত্যাচারকালে শিবের পীঠস্থান। ভুবনেশ্বরেও এসে দৌরাত্মা আরম্ভ করলে শিবের পরামর্শক্রমে নন্দী গড় সেতারার বর্ণি রাজাকে স্বপ্নাদেশ দেন :
আছয়ে বর্গির রাজা গড় সেতারায়।
আমার ভকত বড় স্বপ্ন কহ তায়।।
সেই আসি যবনেরে করিব দমন।
শুনি নন্দী তারে গিয়া কহিলা স্বপন ৷৷
স্বপ্ন দেখি বর্ণিরাজা হইল ‘ক্রোধিত পাঠাইল রঘুরাজ ভাস্কর পণ্ডিত।
এক তীব্র মুসলিমশাসন-বিরুদ্ধতা এবং শাসকশক্তির প্রতি
এক তীব্র মুসলিমশাসন-বিরুদ্ধতা এবং শাসকশক্তির প্রতি অনাস্থা পংক্তিগুলির সর্বাঙ্গে। সুতরাং অন্যবিধ এক বিচ্ছিন্ন মানসিকতা নিয়েই ভারতচন্দ্রের কাব্যে স্বপ্নাদেশ প্রসঙ্গ এসেছে। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের কবিরা দৈবাদেশের দিকে তাকিয়ে থাকেন ভক্তিপ্রবাহে আত্মবিলোপ করে দিতে, যেমন করেছেন বিজয় গুপ্ত প্রমুখেরা
আমি বটি যন্ত্র মাগো বক্সী বঁট তুমি।
যা বলে বাজাও যত্ন তা বলিব আমি। [ পদ্মাপুরাণ ।
এখানে দেবীবন্দনার ব-কলমে এই ব্যক্তিত্বলোপ কোনো অসহায়তা বা অযোগ্যতার নিদর্শন নয়—আত্মবিশ্বাসের এই বিপর্যয় যেখানে তাদের সুভাষিত কবিকর্মেরই অঙ্গীকৃত — সেখানে ভারতচন্দ্রের নির্দ্বিধ উচ্চারণ :
নূতন মঙ্গল আশে
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আজ্ঞায়