চিত্রাঙ্গদা চরিত্র –
চিত্রাঙ্গদা মধুসূদনের অভিনব সৃষ্টি, বাল্মীকির রামায়ণে চিত্রাঙ্গদার উল্লেখ নেই, কৃত্তিবাসী রামায়ণে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র। মধুসূদনের কাব্যে চিত্রাঙ্গদা আপন স্বাতন্ত্র্যে সুস্পষ্ট এবং তার চরিত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে।
কাব্যের প্রারম্ভে বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদে লঙ্কাধিপতি রাবণ যখন শোকে মুহ্যমান তখন রাজসভায় চিত্রাঙ্গদার প্রবেশ। এবং চিত্রাঙ্গদার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে রাজসভাগৃহে তার প্রভাব প্রকাশ পেয়েছে –
“চমকিলা লঙ্কাপতি কনক আসনে।”
অথচ চিত্রাঙ্গদার মুখে তখনও কোনও কথা শোনা যায় নি। তাঁর নীরব শোকাপ্লুত উপস্থিতিই রাবণ এবং তাঁর রাজসভাকে স্তম্ভিত করার পক্ষে যথেষ্ট।
চিত্রাঙ্গদার শান্ত আবেদন –
“একটি রতন মোরে দিয়েছিল বিধি/কৃপাময়”
এর উত্তরে রাবণ আত্মপক্ষ সমর্থনে গভীর প্রত্যয়ের সুরে আবৃত্তি করেন –
১) “এ বৃথা গঞ্জনা, প্রিয়ে, কেন দেহ মোরে”
২) “এক পুত্র শোকে তুমি আকুলা, ললনে
শত পুত্র শোকে বুক আমার ফাটিছে
দিবানিশি!”
এবং বীরত্ব ও দেশপ্রেমের আদর্শলোক থেকে দু’চার সান্ত্বনা বাক্য দিয়ে চিত্রাঙ্গদাকে নীরব করতে চাইলে সে প্রচেষ্টা মর্মান্তিক ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এর ব্যাখ্যায় যোগীন্দ্রনাথ বসু বলেছেন –
“সন্তানকে স্বদেশের কল্যাণের জন্য ধর্মযুদ্ধে
নিহত হইতে দেখিলে বীর জননীর প্রাণে সান্ত্বনা আসিতে পারে সত্য, কিন্তু অপরের পাপ-তৃষারূপ অগ্নিতে হৃদয়ের ধনকে আহুতিরূপে অর্পিত হইতে দেখিলে বীর জননীর প্রাণে যে যন্ত্রণা হয়, তাহা কে বুঝিবে ?”
তাই ‘বীরকর্ম্মে হতপুত্র’ – রাবণের এই উক্তির ভন্ডামি চিত্রাঙ্গদার পক্ষে অসহ্য। জ্বালাময় বাক্যস্রোতে তিনি প্রমাণ করতে চান যে লঙ্কার কালসমরের একমাত্র কারণ রাবণের পাপবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই তাঁর জিজ্ঞাসা –
১) “কিসের কারণে,
কোন লোভে, কহ রাজা, এসেছে এ দেশে রাঘব ?”
২) “কে কহ এ কাল অগ্নি জ্বালিয়াছে আজি
লঙ্কাপুরে?”
আসলে চিত্রাঙ্গদা রাবণের একাধিক মহিষীর একজন এবং চিত্রাঙ্গদার যে ছবি চিত্রিত হয়েছে তাতে তিনি বিগতযৌবনা নয়, ফলে রাবণের সঙ্গে তার বয়সের ব্যবধানও অল্প নয়। অসমবয়সী যুবতী চিত্রাঙ্গদা রাবণের সঙ্গ পাননি এবং তাঁর অতৃপ্ত আবেগানুভূতি তৃপ্ত করতে চেয়েছেন একটি মাত্র সন্তানকে অবলম্বন করে। তাঁর নারীত্ব ধূলায় অবলুন্ঠিত হলেও মাতৃত্ব চরিতার্থ হয়েছে বীরবাহুকে কেন্দ্র করে। তাই আজ যখন তাঁর বিক্ষুব্ধ জীবনের সেই অবলম্বন করে। তাঁর নারীত্ব ধূলায় অবলুন্ঠিত হলেও মাতৃত্ব চরিতার্থ হয়েছে বীরবাহুকে কেন্দ্র করে। তাই আজ যখন তাঁর জীবনের সেই অবলম্বনটুকু খসে যায় তখন বাঁধভাঙ্গা স্রোতের ন্যায় পুত্রশোকের মধ্য দিয়ে সেই চিরসঞ্চিত ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ চিত্রাঙ্গদা স্বল্পপরিসরে অঙ্কিত হলেও তার মধ্য দিয়ে নবযুগের নারীত্ব বিদ্রোহিনী মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। অন্দর থেকে সদরে তাঁর অনায়াস প্রবেশ, সহজ যুক্তির ভিত্তিতে নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা, বুদ্ধির আধারে জীবনকে দেখার মানসিকতা – চিত্রাঙ্গদা চরিত্রটি আপন বৈশিষ্ঠ্যে সমুজ্জ্বল। রাবণ যখন তাঁর পরাজয় সম্পর্কে সচেতন, এবং এর জন্য বিধি অদৃষ্টকে দোষ দিচ্ছেন তখন চিত্রাঙ্গদার সহজ সচেতন প্রতিবাদ –
“হায়, নাথ, নিজ কর্ম্মফলে,
মজালে রাক্ষসকূল, মজিলা আপনি।”
তেজস্বিতা আছে বলে যে নারী চরিত্রের কোমলতার সৌন্দর্য ক্ষুন্ন হয়েছে তা নয়, আছে শোকের পর্যাপ্ত দীনতা, নারীহৃদয়ের অসীম আকুলতা, স্বামীর প্রতি আনুগত্য অথচ অন্যায় অধর্মের প্রতিবাদেও কোনো দূর্বলতা প্রশ্রয় পায়নি। কুসুমকোমল নারী সত্তার মধ্যে নিহিত আছে বজ্র কঠোরতা। এই আপাত বিরোধী বিচিত্র শক্তি ও প্রবণতার সমাবেশে চিত্রাঙ্গদা চরিত্রটি হয়ে উঠেছে অনুপম, অনন্য এবং অনবদ্য।