বুনিয়াদি শিক্ষা 1937 1947 (Basic Education 1937 – 1947)

ভূমিকা (Introduction)

ভারত শাসন আইন 1935 খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত হওয়ার ফলে 1937 খ্রিস্টাব্দে ভারতের সাতটি প্রদেশে কংগ্রেসি মন্ত্রীসভা দেশ শাসনের ভার গ্রহণ করে। মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করার পূর্বে কংগ্রেস ক্রমাগত দাবি করে এসেছে দেশে সর্বজনীন অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা হোক। মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করার পর এই দাবিকে বাস্তবে রূপ দেবার দায়িত্ব তাদের গ্রহণ করতে হল। কিন্তু সর্বজনীন অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, প্রাদেশিক সরকারগুলির হাতে সে পরিমাণ অর্থ ছিল না। কংগ্রেসি মন্ত্রীরা যখন এই জটিল অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারছিলেন না, তখন মহাত্মা গান্ধি এগিয়ে এলেন তাঁর নিজস্ব জাতীয় শিক্ষা পুনর্গঠন পরিকল্পনা নিয়ে। 1937 খ্রিস্টাব্দে হরিজন পত্রিকায় তিনি শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর বৈপ্লবিক পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। বাধ্যতামূলক সর্বজনীন অবৈতনিক শিক্ষাকে অর্থের অভাবে পিছিয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। শিক্ষা হবে শিল্পকেন্দ্রিক ও স্বনির্ভর। এটিই হল বুনিয়াদি শিক্ষার মূল ভিত্তি।

* বুনিয়াদি শিক্ষার ধারণা (Concept of Basic Education)

গান্ধিজি প্রবর্তিত এই শিক্ষাকে বুনিয়াদি শিক্ষা বলার কারণ এই শিক্ষা হবে স্বনির্ভর, স্বাবলম্বী, ভবিষ্যৎ জীবন গঠনের ভিত্তিভূমি, যার বুনিয়াদের ওপর গড়ে উঠবে পূর্ণবিকশিত সার্থক জীবনের সফলতার ইমারত। বুনিয়াদি শিক্ষা দর্শনের গোড়ার কথা হল সহযোগিতার ভিত্তিতে সমাজের পুনর্গঠন, শ্রেণিহীন, শোষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার আশা ও আশ্বাস। বুনিয়াদি শিক্ষার মূলকথা হল কাজের মধ্য দিয়ে জ্ঞান আহরণ। বুনিয়াদি শিক্ষা পরিচালিত হবে কোনো একটি শিল্পকে কেন্দ্র করে, যা শিক্ষার্থীদের উৎপাদনমুখী কাজের সঙ্গে জড়িয়ে রেখে শিক্ষার জন্য অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করবে।

* বুনিয়াদি শিক্ষার বিকাশ (Development of Basic Education)

গান্ধিজি যখন হরিজন পত্রিকায় নটা তালিম বা নতুন শিক্ষা পরিকল্পনাটি প্রথম প্রকাশ করেন তখন শিক্ষাবিদদের মধ্যে সেই শিক্ষাচিন্তা নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। অবশেষে 1937 খ্রিস্টাব্দে ওয়ার্ধায় অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় শিক্ষা সম্মেলনে গান্ধিজির এই পরিকল্পনাটি গৃহীত হয়। ‘ওয়ার্ধায় এই পরিকল্পনাটি গৃহীত হয় বলে একে ওয়ার্ধা পরিকল্পনা (Wardha Scheme) বলা হয়। ওয়ার্কা পরিকল্পনায় নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলি গৃহীত হয়-

(i) সমগ্র জাতীয়স্তরে বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। (ii) মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার।

(iii) শিশুর শিক্ষা একটি উৎপাদনাত্মক শিল্পকে কেন্দ্র করে দেওয়া হবে।

(iv) এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ধীরে ধীরে শিক্ষার ব্যয় নির্বাহ হবে। এই সম্মেলনে ড. জাকির হোসেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে তার ওপর বুনিয়াদি শিক্ষার একটি পাঠ্যক্রম রচনার ভার দেওয়া হয়। নানা আলোচনার পর ওই কমিটি একটি রিপোর্ট পেশ করেন। জাতীয় কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনে (1938 খ্রিস্টাব্দে) জাকির হোসেন কমিটির প্রস্তাবসমূহ গৃহীত হয়।

1939 খ্রিস্টাব্দে হিন্দুস্থান তালিম সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। বুনিয়াদি শিক্ষাপদ্ধতির পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য এই সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর বিহার, উড়িষ্যা প্রভৃতি প্রদেশে পরীক্ষামূলকভাবে বুনিয়াদি শিক্ষার কাজ আরম্ভ হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও কংগ্রেসি মন্ত্রীদের পদত্যাগের ফলে বুনিয়াদি শিক্ষার অগ্রগতি 1940 থেকে 1944 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাধাপ্রাপ্ত হয়।

1944 খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধোত্তর শিক্ষার জন্য সার্জেন্ট পরিকল্পনায় ধুনিয়াদি শিক্ষাকে গ্রহণ করায় কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার বুনিয়াদি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে আরম্ভ করে। 1945 খ্রিস্টাব্দে সেবাগ্রামে বুনিয়াদি শিক্ষার এক সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনে বুনিয়াদি শিক্ষাকে শিক্ষাক্ষেত্রে বিপ্লব আখ্যা দেওয়া হয়। বুনিয়াদি শিক্ষার সাহায্যে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্বিক পরিবর্তন আসবে এবং নবজীবনের সূচনা হবে বলে তাঁরা মনে করলেন। তখন থেকে বুনিয়াদি শিক্ষা নঈ তালিম নামে পরিচিত হয়।

নঈ তালিম বুনিয়াদি শিক্ষা পরিকল্পনায় গান্ধিজির চারটি নঈ স্তরে শিক্ষার কথা বলেন

(i) প্রাক্, বুনিয়াদি শিক্ষা 7 বছরের কমবয়সি শিক্ষার্থীদের জন্য।

(ii) বুনিয়াদি শিক্ষা 7 থেকে 14 বছরের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা। (iii) উত্তর বুনিয়াদি শিক্ষা 15 বছরের ঊর্ধ্বে বয়স্কদের শিক্ষা।

(iv) প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষা প্রত্যেক স্তরেই কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই নয়া তালিমের মধ্য দিয়ে সমাজে বিপ্লব সাধিত হবে বলে মনে করা হয়। 1946 খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন প্রদেশে কংগ্রেসি মন্ত্রীসভা গঠিত হবার পর আবার বুনিয়াদি

বুনিয়াদি শিক্ষার লক্ষ্য (Aims of Basic Education)

গান্ধিজির মতে শুধু আক্ষরিক জ্ঞান অর্জনকে শিক্ষা বলে না। ব্যক্তিত্বের শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা। শিক্ষা হল ব্যক্তির অন্তর্নিহিত দৈহিক, মানসিক, এবং আধ্যাত্মিক সর্বপ্রকার সত্তার বিকাশ। শুধু পার্থিব সম্পদ বৃদ্ধিই নয়, আধ্যাত্মিক শক্তি প্রকাশ হবে শিক্ষার চরম লক্ষ্য। তাই বুনিয়াদি শিক্ষার লক্ষ্য হবে—

(i) শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে উপার্জন এবং উপার্জন করতে করতে শিক্ষা। অর্থাৎ, শিক্ষার লক্ষ্য হবে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন।

(ii) অপরের ওপর নির্ভরশীলতা ব্যক্তিকে অলস করে তোলে। তাই শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য স্বাবলম্বন হওয়া অত্যাবশ্যক। ফলে স্বাবলম্বনতা অর্জন হবে। শিক্ষার আর একটি লক্ষ্য ।

(iii) গান্ধিজির মতে, আত্মসংযমের মধ্য দিয়ে চরিত্র গঠন করা শিক্ষার একটি অন্যতম লক্ষ্য। পঠন, লিখন, গণিত ( 3 R’s) শিক্ষার চেয়ে তিনি হস্ত, মস্তক ও হৃদয়ের (3H) শিক্ষাকে বড়ো করে দেখতেন। এজন্য তিনি চরিত্র গঠন ও নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

(iv) গান্ধিজির শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীদের ভারতের প্রাচীন কৃষ্টির সঙ্গে পরিচয় ঘটানো।

(v) আত্মোপলথিই হল ঈশ্বরকে লাভ করার একমাত্র উপায়। তাই আত্মোপলব্ধি শিক্ষার চরম লক্ষ্য বলে গান্ধিজি মনে করতেন। (vi) গান্ধিজি বুনিয়াদি শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের

সমন্বয় চেয়েছেন।

বুনিয়াদি শিক্ষার বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Basic Education)

 (i) কোনো একটি শিল্পকর্মকে কেন্দ্র করে শিশু সক্রিয় ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে নানাবিষয়ে শিক্ষালাভ করবে।

(ii) এই শিক্ষাব্যবস্থায় সমাজ ও বিদ্যালয়ের সংযোগ সাধন হবে।

(iii) বুনিয়াদি শিক্ষা কোনো একটি শিল্পকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হবে। এমন একটি

শিল্প বেছে নিতে হবে, যা স্থানীয় পরিবেশের পক্ষে অনুকুল ও যাতে শিশুর স্বাভাবিক আগ্রহ আছে এবং যা থেকে রকমারি জ্ঞানলাভের সুযোগ আছে। (iv) মাতৃভাষা হবে শিক্ষার বাহন।

(v) এই ধরনের শিক্ষায় দৈহিক শ্রম ও জ্ঞানের সমন্বয় সাধন হবে।

(vi) এই শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক হবে।

(vii) একটি অর্থকরী বৃত্তিশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষাধ

শিল্পশিক্ষার কাজে যে দ্রব্যগুলি উৎপন্ন করবে, সেগুলি বিক্রয় করে যে অর্থ সংগ্রহ হবে, তা দিয়ে শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ হবে। (viii) গান্ধিজি প্রস্তাব করেছিলেন প্রাথমিক শিক্ষা সাত বছর ব্যাপী হবে।

বুনিয়াদি শিক্ষার পাঠ্যক্রম (Curriculum of Basic Education)

মহাত্মা গান্ধির মতে শিক্ষা হবে শিক্ষার্থীর জীবনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাই তিনি পাঠ্যক্রম নির্বাচনের সময় এমন সব বিষয়কে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন, যার সঙ্গে শিক্ষার্থীর সমাজজীবনের সম্পর্ক আছে। যথা—ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি। মাতৃভাষাকে পাঠ্যবিষয় ও পাঠদানের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে বলেছিলেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি হস্তশিল্পের ওপর বেশি গুরুত্ব দান করেছিলেন। মূল হস্তশিল্প হল সুতাকাটা, তাঁতবোনা, কৃষিকাজ, কাগজের কাজ, ধাতুর কাজ প্রভৃতি। এ ছাড়া গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান, ছবি আঁকা, সংগীত, বাধ্যতামূলক শরীরচর্চার ব্যবস্থাও পাঠ্যক্রমে ছিল। এই পাঠ্যক্রমে ইংরেজি শিক্ষার কোনো স্থান ছিল না। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন এ ধরনের পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশ সম্ভব হবে।

ঙ্গ বুনিয়াদি শিক্ষার গুণাবলি (Merits of Basic Education)

বুনিয়াদি শিক্ষা পরিকল্পনার ভালো দিকগুলি হল যে (i) এই শিক্ষা ভারতের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের উৎপাদনশীল, স্বয়ং নির্ভর এবং জীবনমুখী

করে তুলতে পারবে।

(ii) কায়িক শ্রমের সঙ্গে শিক্ষার সমন্বয় হলে সমাজে শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের মধ্যে ভেদাভেদ দূর হবে ।

(ii) এই শিক্ষার সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতি যুক্ত বলে এই শিক্ষা গ্রামজীবনের উপযোগী হয়ে উঠবে।

(iv) এই শিক্ষার সাহায্যে শ্রেণিহীন, শোষণহীন সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। (c) এই শিক্ষা শিক্ষার্থীকে সমাজ সচেতন ও সমবায় জীবনের উপযোগী করে তুলতে পারবে

(vi) এই শিক্ষা পরিকল্পনায় কাজের সাহায্যে জ্ঞান আহরণের চেষ্টা দেশের মাটির ও জীবনধারার সঙ্গে যোগসূত্র সৃষ্টি করতে পারে। (vii) বুনিয়াদি শিক্ষায় শিক্ষার্থীর আবেষ্টনীকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Cost effective solutions for sans 10400 xa compliance. Tushar enterprises pen raigad. Blog dm developments north west.