ভূমিকা (Introduction)
নিজ স্বার্থে ইংরেজ সরকার ভারতবর্ষে যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, তা মোটেও জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা ছিল না। জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা হল সেই শিক্ষা, যে শিক্ষার মূল শিকড় এ জাতির ঐতিহ্যের মধ্যে নিহিত, যার উৎস হল জাতীয় জীবনরস, শিক্ষা, সমগ্র দেশবাসীর সর্বোচ্চ উন্নতি ও পরিপূর্ণ আত্মবিকাশ ঘটায়, যে শিক্ষা জাতির রীতিনীতি, আচার, মূল্যবোধ ও কল্যাণকর জীবনদর্শন অর্জনে সাহায্য করে, যে শিক্ষা জাতির অতীত সংস্কৃতি ও ভবিষ্যৎ প্রগতির মধ্যে যোগসূত্র রচনা করে।
ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় গণশিক্ষার অতি সামান্য আয়োজনই ছিল। ভ্রান্ত ‘টুইয়ে পড়া নীতি’ দ্বারা পরিচালিত হয়ে প্রত্যক্ষভাবে গণশিক্ষাকে অবহেলা করে উচ্চশিক্ষার জন্য সমস্ত শক্তি, অর্থ নিয়োগ করাই ছিল সরকারি শিক্ষানীতি। ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে ভারতে জাতীয়তাবাদ উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কহীন ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। গণশিক্ষার ব্যবস্থা, কারিগরি ও বৃত্তি শিক্ষার ব্যবস্থা, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান ও শিক্ষার প্রসার প্রভৃতির জন্য দেশের শিক্ষিত জনগণ দাবি তোলেন। ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ জাতীয় জীবনে শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে শিক্ষা প্রসারেও আত্মনিয়োগ করেন। অনেকে এগিয়ে এসে বিদ্যালয়, কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের প্রতিষ্ঠিত কলেজগুলিতে উন্নত ধরনের পরিচালনার মাধ্যমে জাতীয় বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখে শিক্ষা দেবার চেষ্টা চলতে থাকে। বিজাতীয় প্রভাবমুক্ত এই সব কলেজের শিক্ষার মধ্য দিয়ে ছাত্রদের চরিত্র ও জাতীয়তাবাদ উন্মেষের চেষ্টা চলতে থাকে। এর ফলস্বরূপ জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন 1905 খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় এবং 1920 খ্রিস্টাব্দে এর সমাপ্তি ঘটে।
* জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের কারণ (Cause of National Education Movement)
কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। অনেকগুলি কারণ সংঘবদ্ধ হয়ে এই আন্দোলন ঘটিয়েছিল। সেই কারণগুলি সংক্ষেপে তুলে ধরা হল-
(i) ইংরেজ সরকার এদেশে যে শিক্ষার প্রবর্তন করেছিল তাতে জাতীয় শিক্ষার দাবি
অবহেলিত হয়েছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে ভারতবাসী নিজ দেশের সভ্যতা সংস্কৃতি ভুলতে বসেছিল। এর ফলে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত ভারতবাসীর মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান সৃষ্টি হচ্ছিল। ফলে সমাজচিন্তক শিক্ষিত জনগণ ইংরেজ প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন।
(ii) ভারতীয় জনগণ চেয়েছিল শিক্ষার মাধ্যমে চিন্তা ও কর্মে স্বাধীন ভারতীয় গড়ে তুলতে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার নিজ বাণিজ্য ও শাসনকার্যের সুবিধার জন্য একজন কেরানি তৈরি করতে ও একদল ব্রিটিশ রাজভক্ত প্রজা সৃষ্টি করতে শিক্ষাকে কাজে লাগাতে শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল।
(iii) প্রচলিত শিক্ষার প্রশাসন ছিল সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশদের হাতে। শিক্ষার লক্ষ্য, পদ্ধতি, শিক্ষার মাধ্যম, আইনকার্য প্রভৃতি সকল বিষয় ব্রিটিশরা নিজ সুবিধা অনুযায়ী স্থির করত। এসব ব্যাপারে ভারতীয়দের মতামত গ্রাহ্য হত না।
(iv) শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে না-মেনে নিয়ে মাতৃভাষাকেই মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার কারার দাবি ছিল জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম কারণ।
(v) ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় গণশিক্ষার আয়োজন ছিল অতি সামান্য। গণশিক্ষাকে অবহেলা করে উচ্চশিক্ষার জন্য সমস্ত শক্তি ও অর্থ ব্যবহার করাই ছিল সরকারি শিক্ষানীতি।
(vi) এই শিক্ষা ছিল মূলত পুথিগত শিক্ষা। এই বাস্তববর্জিত তাত্ত্বিক শিক্ষা কেবল
মুষ্টিমেয় মানুষের সরকারি চাকুরির সুযোগ করে দিয়েছিল। এই শিক্ষার সঙ্গে দেশের নাড়ির কোনো যোগসূত্র ছিল না। (vii) মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ উচ্চশিক্ষা লাভে সক্ষম হলেও সমাজের অগণিত লোক স্বাধীন
শিক্ষার আলোক থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত ছিল।
(viii) 1899 খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন ভারতের বড়োলাট হয়ে আসেন। জাতীয় আশা- আকাঙ্খাকে উপেক্ষা করে তিনি আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শিক্ষা সংকোচনের নীতি গ্রহণ করেন। কার্জনের শিক্ষা সংকোচনের নীতি ভারতবাসীর অসন্তোষ বৃদ্ধি করেছিল। ভারতের জনমত কার্জনের 1904 খ্রিস্টাব্দের শিক্ষা আইনের তীব্র নিন্দায় মুখরিত হয়ে ওঠে। জাতীয়তাবাদীদের নেতৃত্বে ভারতের জাতীয়তাবাদ তখন একটি বিদ্রোহী আকার ধারণ করে।
(ix) শিক্ষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভারতীয়দের বিভিন্ন কমিটি বা কমিশনে অন্তর্ভুক্ত না-করাও আন্দোলনের অন্যতম অনুঘটক ছিল।
(x) ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের চরিত্রের কিছু পরিবর্তন হয়। এই সময় নরমপন্থীদের আবেদন- নিবেদনের পালা শেষ হয়ে চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়। ফলে বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থাকে দেশের নেতৃবৃন্দ মনেপ্রাণে মেনে নিলেন না।
(xi) প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার উপাদানের অভাব দূর করে ভারতীয় আদর্শ অনুযায়ী ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে।
(xii) কার্জনের বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা বারুদস্তূপে অগ্নিসংযোগ করল। বঙ্গভঙ্গের ফলে স্বদেশি নেতৃবৃন্দ আন্দোলন শুরু করলেন। কার্জনের দমননীতি জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের আশু কারণ হিসেবে গণ্য হল। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে স্বদেশি নেতৃবৃন্দ স্বদেশি আন্দোলন শুরু করলেন। বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করার জন্য যে
আন্দোলন শুরু হয় সে আন্দোলনে দেশের ছাত্ররাও দলে দলে যোগ দেয়। (xiii) পুনরুজ্জীবন জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের একটি অন্যতম কারণ। 1897 খ্রিস্টাব্দে রামকৃষ্ণ মিশন প্রাচীন ভারতীয় আদর্শের পুনরুজ্জীবন আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। পরাধীন জাতির মুক্তি আন্দোলনকালে এক শ্রেণির শিক্ষাবিদ ভারতের সুপ্রাচীন সভ্যতার দিকে লক্ষ্য দিলেন, প্রাচীন গৌরবের মধ্যে সান্ত্বনা পেতে চাইলেন এবং প্রাচীন আদর্শের পুনরুজ্জীবনের স্বপ্ন দেখলেন।
(xiv) কার্লাইল সার্কুলার ( 22 অক্টোবর, 1905) জারি হলে আগুনে ঘৃতাহুতি হয়। এতে বলা হয় যে, স্কুলের প্রধান শিক্ষকগণ ছাত্রদিগকে স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দেওয়া থেকে নিবৃত্ত করবেন। নতুবা স্কুলের সরকারি অর্থ সাহায্য বন্ধ হবে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে স্বদেশি আন্দোলনের পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।