জীবনানন্দ দাশের ‘তিমির হননের গান’ কবিতাটি ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। জীবনানন্দ দাশ জীবনের নৈরাশ্য, হতাশা, বিষন্নতা এবং নিসঙ্গতাকে অতিক্রম করে শেষপর্যন্ত আস্তিক্যবোধের উপর আস্থা রেখেছেন। ‘তিমির হননের গান’ কবিতায় সেই আস্তিক্যবোধের প্রকাশ ঘটেছে। এই কবিতায় তিনি তিমির তথা অন্ধকারকে দূর করে সূর্যের আলোর প্রত্যাশা করেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও বিয়াল্লিশের মন্বন্তরের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে কবি খুঁজেছেন নতুন দিনের সূর্যকে। ইতিহাসের সত্যে বিশ্বাসী কবি বিশ্বাস করতেন, মানব জীবনের যাবতীয় অশুভ রাত্রির একদিন অবসান ঘটবেই। তাই কবি ‘তিমির হননের’ ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
‘তিমির হননের গান’ কবিতার প্রথম অংশে কবির কিছুটা হতাশা লক্ষ করা যায়। তিনি বলেছেন- “সূর্যালোক নেই-“
আসলে দুর্ভিক্ষ এবং মানুষের উদাসীনতা কবিকে নিরাশ করেছিল। মধ্যবিত্ত মানুষের গতানুগতিক জীবনধারায় তিনি হতাশা বোধ করেন-
“মধ্যবিত্ত মানুষের বেদনার নিরাশার হিসেব ডিঙিয়ে নর্দমার থেকে শূন্য ওভারব্রিজে উঠে
নর্দমায় নেমে-”
মধ্যবিত্ত মানুষেরা চিরকালই নর্দমা থেকে ওভার ব্রিজে এবং পুনরায় নর্দমাতে নেমে আসে। তাইতো মন্বন্তর শেষ হলে পুনরায় নেমে আসে নবমন্বন্তর। মানুষের জীবনের উত্তোরণ হীনতাকে লক্ষ করে কবি বলেছেন- “স্মরণীয় উত্তরাধিকারে কোন গ্লানি নেই ভেবে একদিন ভালোবেসে গেছি।”
মন্বন্তরের দিনগুলিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে কবির মনে হয়েছে, লঙ্গরখানায় উপস্থিত কালো কালো ছায়া। তিনি হতাশ হয়েছিলেন মানুষের নিস্পৃহ ব্যবহারে। নক্ষত্রের জ্যোৎস্নায় মানুষের ঘুমিয়ে পড়াকে তাঁর মৃত্যুসম মনে হয়েছিল-
“মধ্যবিত্তমদির জগতে আমরা বেদনাহীন- অন্তহীন বেদনার পথে।”
এখানে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, কবি কোন জীবনদর্শনে বিশ্বাসী? তিনি কি আলোর মধ্যে অন্ধকারের খোঁজ করেছেন? কিন্তু তা যে সত্য নয়, তা আলোচ্য কবিতার শেষাংশেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে- “আমরা তো তিমিরবিনাশী।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটেও কবির অন্ধকারকে দূর করে আলোর প্রত্যাশা করেছেন। কবিতায় ব্যবহৃত দুটি পংক্তির মধ্যে তার ইঙ্গিত রয়েছে-
১. “সূর্যালোক মনোরম মনে হ’লে হাসি।”
২. “সূর্যালোক প্রজ্ঞাময় মনে হ’লে হাসি।”
কবিতায় ব্যবহৃত এই দুটি বাক্যের মধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে কবির আশাবাদী মানসিকতার।
অন্ধকার, নিরাশা, হতাশা, ব্যর্থতা, গ্লানি প্রভৃতি বিষয়গুলি মানব জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, কিন্তু জীবনের শেষ সত্য নয়। তাই কবি কবিতার শেষে বলেছেন-
“আমরা কি তিমিরবিলাসী?
আমরা তো তিমিরবিনাশী
হ’তে চাই।
আমরা তো তিমিরবিনাশী।”
এক গভীর আস্তিক্যবোধ থেকেই কবি এই বিশ্বাসে উপনীত হয়েছেন। তাই আলোচ্য কবিতাটি একটি আশাবাদের কবিতা, কবির ইতিবাচক মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে এখানে। এখানেই কবিতাটির সার্থকতা এবং নামকরণ সার্থক।