রবীন্দ্র পরবর্তী সময়কালে বাংলা কাব্যসাহিত্যে জীবনানন্দ দাশ একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। জীবনানন্দের কবিতায় বর্তমান যুগের মনুষ্যত্বহীনতা, মানুষের যান্ত্রিকতা এবং কৃত্রিমতা প্রকাশ পেয়েছে ঠিকই, তবে এইসব নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে অতিক্রম করে জীবন সম্পর্কে এক প্রবল আশাবাদ ধ্বনিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘শিকার’ কবিতাটি এই ধরনেরই একটি কবিতা।
কবিতাটিতে ‘ভোর’ শব্দটি দু’বার ব্যবহৃত হয়েছে। এই ভোর যেন ‘আশাবাদী জীবনের হাতছানি’। তবে দু’টি ভোরের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। প্রথম স্তবকের সূচনায় একটি ‘ভোর’ শব্দের ব্যবহার করে কবি আমাদের কৌতূহলী করে তোলে। এরপরে ভোরের প্রশস্তি করতে গিয়ে কবি নীল এবং সবুজ- এই দুটি রঙের বিন্যাস ঘটিয়েছেন কবি। আকাশে তারার অবস্থানের কথাও বলেছেন। তবে এই ভোরের মুখে একটা মৃত্যুর ছায়া পড়েছে। নীল রঙ মৃত্যুর প্রতীক। মৃত্যুর ছায়ার মধ্যেও প্রাণের সবুজ উল্লাস ও প্রেমকে কবি অস্বীকার করেননি। কবি লিখেছেন-
“একটি তারা এখনো আকাশে রয়েছে,
পাড়াগাঁর বাসর ঘরে সবচেয়ে গৌধূলি-মদির মেয়েটির মতো;” শীতের রাতে মানুষ আগুন জ্বালে একটুখানি উষ্ণতার জন্য। মৃত্যু যদি শীতের রাতের প্রতীক হয়, তবে উষ্ণতা বেঁচে থাকার প্রতীক। এই বেঁচে থাকার ইচ্ছা থেকেই মানুষের মনে মৃত্যুর বিপরীত অর্থাৎ জীবনকে ভোগের বাসনা প্রকাশিত হয়। তবে শেষপর্যন্ত সবই শেষ হয়ে যায়। জীবনের শুরুতে যে রঙ-রূপ-ঐশ্বর্যে মানুষ রঙিন হয়ে ওঠে, জীবনের শেষ পর্যায়ে সেই রূপ অনেকটাই যে ফ্যাকাসে হয়ে যায়, তা অস্বীকার করা যায় না।
কবিতার চতুর্থ স্তবকের শুরুতে আবার ‘ভোর’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এই ভোরের মধ্য দিয়ে কবি এখানে আত্মরক্ষার এক শোচনীয় ছবি তুলে ধরেছেন। কবি লিখেছেন- “সারারাত চিতাবাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে
বাঁচিয়ে-বাঁচিয়ে” চলতে হয়। জীবন যেন নক্ষত্রহীন এক রাত্রি। ঘন অন্ধকারে সুন্দর হরিণ যেমন একটি ভোরের জন্য অপেক্ষা করে, মানুষও তেমনি একটি ভোরের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। ভোর হওয়ার পর সুন্দর বাদামী হরিণটি ভোরের আলো গায়ে মেখে “কচি বাতাবী লেবুর মতো সবুজ সুগন্ধি ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে।” এই ঘাস ছিড়ে খাওয়া তো প্রাণের উল্লাসের প্রতীক। শুধু তাই নয় খাওয়ার পর সে যখন নদীর তীক্ষ্ণ শীতল ঢেউয়ে নামে, তখন তো আসলে তার মধ্যে জীবনকে উপভোগের ইচ্ছাই প্রবল হয়ে ওঠে। কিন্তু জীবন উপভোগের ইচ্ছা যতই প্রবল হোক না কেন, জীবনকে ধরে রাখা বোধ হয় সবসময় ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না।
তাইতো কবিতার শেষ স্তবকে কবি একটা ক্লাইমেক্সে পৌঁছে গেছেন- “একটা অদ্ভুত শব্দ।
নদীর জল মচকাফুলের পাপড়ির মতো লাল।”
ভয়ংকর প্রাণঘাতী সেই শব্দ। বাঘের নখ থেকে বেঁচে যে হরিণ প্রাণের উল্লাসে মেতে উঠেছিল, ভেবেছিল এবার সে জীবনটাকে ভোগ করতে পারবে, তার ধারণা যে কতটা ভুল ছিল, ওই অদ্ভুত শব্দই তার প্রমাণ। হরিণটি জানত না, অরণ্যের পরেই আছে জনারণ্য। সেখানে হিংস্র পশু নেই, আছে শিকারী। তার বন্দুকের একটি গুলিতে হরিণের রক্তে লাল হয়ে যায় নদীর জল। আবার আগুন জ্বলে এবং উষ্ণ লাল হরিণের মাংস রান্না হয়ে যায়।
লক্ষণীয় কবিতার শুরুর দিকে শীতের রাতে শরীরে উষ্ণতার জন্য আগুন জ্বালানোটা ছিল জীবনকে উপভোগের প্রতীক, কিন্তু কবিতার শেষে আগুন জ্বালানো আর লাল শব্দ দুটি হলো মৃত্যুর প্রতীক।
দুটি ভোরের চিত্র পরিবেশন করে কবি মানুষের মনুষ্যত্বহীনতাকেই তুলে ধরেছেন। হরিণ সৌন্দর্যের প্রতীক, ‘ভোর’ জীবনের প্রতীক। কিন্তু একদল মানুষ এই সৌন্দর্যের প্রকৃত রূপকে উপলব্ধি করতে চায় না। তাদের কাছে জীবন মানে ভোগ-তৃষ্ণার। তারা সৌন্দর্যকে হত্যা করে, সিগারেটের ধোঁয়ায় আর হরিণের মাংসে শীতের রাতে উষ্ণতার খোঁজ করে। এই সকল মানুষ চেতনাহীন, সৌন্দর্যহীন। এখানে শুধু হরিণ কিংবা ভোরের মৃত্যু ঘটেনি, মৃত্যু ঘটেছে জীবনের, প্রেমের, সরলতার ও বিশ্বাসের।