রবীন্দ্র পরবর্তী সময়কালে বাংলা কাব্যসাহিত্যে জীবনানন্দ দাশ একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। জীবনানন্দ দাশের একটি বিশিষ্ট কবিতা ‘পিরামিড’। ‘পিরামিড’-কে আশ্রয় করে কবি জীবনানন্দ দাশ এক বিশেষ ইতিহাস চেতনা ও মৃত্যু-চেতনার পরিচয় দিয়েছেন।
পিরামিড ইতিহাসের একটি বিষয়। মিশরের পিরামিডগুলি নির্মিত হওয়ার পর বহু শতাব্দী অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। যুগ-যুগান্তর ধরে ‘দেশ- জাতি-সংসার-সমাজ’-এর অনেক উত্থান-পতন, ভাঙাগড়া ঘটে গিয়েছে, কিন্তু কেউই পিরামিডকে অভিনন্দন জানায়নি। দেশ, জাতি, সমাজের বিদায়ের বাণী পিরামিড কখনো শোনেনি, লক্ষ লক্ষ মরণ-সন্ধানী মানুষের কেউ-ই পিরামিডের কাছে আসেনি। পিরামিড তবুও নির্বাক হয়ে, প্রেতপ্রাণের মতো স্তব্ধ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে আছে। কালের প্রকোপে নতুন নতুন ভাস্কর্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পিরামিড নব উদিত সূর্যের মধ্যে গানের সুর শুনতে পায়, আর তখনই পিরামিডের পাষাণ হৃদয়ে উল্লাসের ছোঁয়া লাগে।
কিন্তু এ উল্লাসও ক্ষণস্থায়ী। শতাব্দীর বিরহী আত্মা, অনন্ত আকাশ, মরুভূমি মিশরের অপহৃত অন্তরের জন্য ভিক্ষা প্রার্থনা করে। কবে তার এই প্রার্থনা পূর্ণ হবে সেই আশাতেই যেন পিরামিড নিথর হয়ে বসে আছে। এ যেন তার শবের সাধনা। কত আগন্তুক, কত কাল, অতিথি, সভ্যতা পিরামিডের কাছে এসে হৃদয়ের কথা বলে গেছে। কিন্তু পিরামিডের হৃদয়ে শুধুমাত্র স্থির প্রতীক্ষা ছাড়া অন্য কোন কথা নেই। সে শুধু তার প্রিয়া অর্থাৎ মহাকালের বুকের উপর বসে শবের সাধনায় আত্মমগ্ন। তার জন্মের উৎসে রয়েছে ব্যাকুল হৃদয়ের যে শপথ তা কবে সত্য হবে- এরই প্রতীক্ষা করছে। এই প্রতীক্ষা সফল হলে তবেই যেন সে পাবে তার প্রেমিকার সোহাগ, মিশরের জীবনের অলি-গলিতে তখন জ্বলে উঠবে সত্যের আলো।
মানবজীবন প্রবাহিত হয়ে চলেছে সম্মুখে। পিছন ফিরে দেখার সময় নেই। সে আত্মবিস্মৃত। তাই যখন প্রিয়জনের মৃত্যু হয়, তখন বেদনায় স্মৃতির শ্মশান গড়ে তোলা হয়। কিন্তু এ স্মৃতিও ক্ষণস্থায়ী- ‘দুদিনের তরে শুধু’। কয়েকদিনের মধ্যে এই বেদনা ভুলে গিয়ে মানুষ কোন ‘নবোৎফুল্লা মাধবীর গান’-এ মেতে ওঠে। তখন মৃত প্রিয়জনের কথা আর মনে হয় না। অতীতের সেই ‘হিমগর্ভ কবর’ তথা পিরামিডের পাশে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলতে মানুষ ভুলে যায়।
যার গুণমুগ্ধ হয়ে, কোনোদিন ভুলবো না ভেবে মানুষ পিরামিড তথা সমাধি নির্মাণ করে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তাকেই ভুলে যায়। মানব সভ্যতার এ এক চিরসত্য বিষয়। জীবনানন্দ মানবসভ্যতার এই চিরসত্য বিষয়টি উপলব্ধি করে তাকেই কবিতার বিষয় করে তুলেছেন। চিরন্তন বিশ্বাসবোধ, প্রেম বা রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন না থেকে কবি এখানে যুগ- যন্ত্রনার ছবি তুলে ধরেছেন। জীবনানন্দ পিরামিডের স্তূপকে বলেছেন “শতাব্দীর শবদেহে শ্মশানের ভষ্মবহ্নি।” এখানে কোনো প্রেমের স্নিগ্ধতা বা রোমান্টিক মোহ নেই। পিরামিডকে দেখে কবি উপলব্ধি করেছেন- “প্রিয়ার বক্ষের’ পরে বসি’ একা নীরবে করিছো তুমি শবের সাধনা-”। পিরামিডের এই প্রতীক্ষা আসলে ইতিহাসের প্রতীক্ষা। অবশ্য কবিতায় কবি ইতিহাসের প্রত্যাশা পূরণের কোনো ইঙ্গিত না দিয়ে, ইতিহাসের প্রতীক্ষাকে অনন্তকালের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তবে ইতিহাসের প্রতি মানবসভ্যতার আগ্রহ হারিয়ে ফেলাকে কবি সভ্যতার সংকট বলে মনে করেছেন।