রবীন্দ্র পরবর্তী সময়কালে বাংলা কাব্যসাহিত্যে জীবনানন্দ দাশ একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটি জীবনানন্দের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। এই কবিতায় কবি হরিণের বিপন্নতার রূপকে আধুনিক যুগের ক্লান্ত মানুষের মগ্নচৈতন্যের সংকটকে প্রকাশ করেছেন।
কবিতাটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে কবি অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হন। সিটি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ কবিতাটি লেখার জন্য কবিকে ভর্ৎসনা করেন। ক্ষুব্ধ কবি এরপর নিজেই কবিতার একটি ব্যাখ্যা দেন। তিনি জানান— “যদি কোন একমাত্র স্থির নিষ্কম্প সুর এ কবিতাটিতে থেকে থাকে, তবে তা জীবনের- মানুষের-কীট-ফড়িঙের সবার জীবনেরই নিঃসহায়তার সুর। সৃষ্টির হাতে আমরা ঢের নিঃসহায়- ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটির ইঙ্গিত এই; এইমাত্র।”
‘ক্যাম্পে’ কবিতাটির মধ্যে তিনি দেখিয়েছেন লোভ-লালসা-হিংসা- স্বার্থপরতার কাছে মানুষ সর্বদা শিকার হয়ে চলেছে। কবিতায় তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন-
“কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার; বনের ভিতরে আজ শিকারীরা আসিয়াছে,”
এখানে বনের বিপন্ন হরিণ আর সমাজের বিপন্ন মানুষ তো এক হয়ে
গেছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালে সমগ্র মানবসমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতা, আর্থিক অনিশ্চয়তা, সম্পর্কের বিশ্বাসহীনতা আর প্রেমহীনতায় মানুষ হয়ে পড়েছিল অসহায়, দিশেহারা। তৎকালীন পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কবির ব্যক্তিগত জীবনের নানান অপূর্ণতা। বেকারত্ব আর দাম্পত্য জীবনের প্রেমহীনতা তাঁকে নিঃস্ব ও আশ্রয়হীন করেছিল। তিনি অনুভব করেছেন—
“বসন্তের জ্যোৎস্নায় ওই মৃত মৃগদের মতো
আমরা সবাই।”
‘ক্যাম্পে’ কবিতার বিষয় হরিণ শিকার। উত্তম পুরুষে লেখা এই কবিতাটিতে কবিই কথক। কবিতার শুরুতেই দেখা যায়, কোনো এক বসন্তের দিনে কবি যেন শিকারিদের সঙ্গে বনের কাছে ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। বসন্তের মোহময়ী প্রকৃতির মধ্যেই চলছে হরিণ শিকারের নির্মম আয়োজন। ঘাই-হরিণের ছলনাময়ী ডাকে বিভ্রান্ত পুরুষ-হরিণ ভাবে- ‘তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে।’ বাঘের ভয় উপেক্ষা করে তারা প্রেমের আস্বাদ পেতে গভীর বনের পথ ছেড়ে ছুটে আসে ‘সুন্দরী গাছের নিচে- জ্যোৎস্নায়।’ আর তারপরে ‘বন্দুকের শব্দ’ এবং ‘খাবার ডিশে হরিণের মাংসের ঘ্রাণ।’ প্রেম- পিপাসু হরিণের এই ট্রাজিক মৃত্যু কবিকে অবসাদগ্রস্ত করে তোলে। তিনি ভাবেন, এই ছলনার জন্য, হরিণের মৃত্যুর জন্য ঘাই-হরিণী কি কাতর হয় না? সভ্যসমাজের হৃদয়হীনতার দ্বারা সেও কী প্রভাবিত হয়েছে? এই তথাকথিত সভ্যসমাজে মানুষের প্রতি মানুষের কোনো সমবেদনা, সহানুভূতি, প্রেম নেই। তাই তো সকলকে শেষ পর্যন্ত ভুলে যেতে হয় বন্দুকের শব্দ।
হরিণ শিকারের মধ্য দিয়ে কবি আসলে মানুষের ট্রাজিক জীবনের প্রকৃত রূপকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। তিনি তো সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “আমার হৃদয়- এক পুরুষ হরিণー”। স্বপ্ন নিয়ে, আশা নিয়ে, প্রেম-প্রত্যাশা নিয়ে আমরাও তো আমাদের অজ্ঞাতে ঐ হরিণদের মতো মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ঘাই-হরিণীর মতো ‘নোনা মেয়েমানুষের’ ছলনায় প্রতারিত হচ্ছি। শুধু পুরুষ নয়, কবি নয়, ফড়িঙ-কীটের মধ্যেও এই একই বিষয় লক্ষ করা যায়। তাই বসন্তের জ্যোৎস্না রাতে হরিণীর ছলনায় যে হরিণেরা মরে, তাদের জন্য কবির দুঃখ সীমাহীন। কিন্তু এর থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়ও তো জানা নেই। শুধু জানা আছে এই প্রেমহীনতা, বিশ্বাসহীনতা, সৌন্দর্যহীনতা আর সম্পর্কহীনতা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে। মানুষের এই আত্মসংকটই ‘ক্যাম্পে’ কবিতায় বিশেষভাবে প্রাধান্য লাভ করেছে।