আট বছর আগের একদিন’ কবিতার ভাববস্তু বিশ্লেষণ করো।  অথবা  ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতা অবলম্বনে কবির জীবন চেতনার পরিচয় দাও।

রবীন্দ্র পরবর্তী সময়কালে বাংলা কাব্যসাহিত্যে জীবনানন্দ দাশ একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটি ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। কবিতাটিতে কবির এক সুগভীর জীবন চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।

মৃত্যু জীবনানন্দের কবিতায় একটি বহু আলোচিত বিষয়। আলোচ্য কবিতাতেও তিনি শুনিয়েছেন এক মৃতের গল্প। কোনো এক ফাল্গুনের পঞ্চমী তিথিতে একজন মানুষ একগাছা দড়ি হাতে উপস্থিত হয় অশ্বত্থের তলে এবং আত্মহত্যা করে। কিন্তু এই আত্মহত্যা করার মতো কোনো বিশেষ নেতিবাচক কারণ তার জীবনে ছিল না। বউ-বাচ্চা-প্রেম-আশা-স্বচ্ছলতা বিলাস- সবকিছুই ব্যক্তিটির জীবনে বর্তমান ছিল। তবুও কেন সেই ব্যক্তিটির কাছে বেঁচে থাকাটা অসহ্য হয়ে উঠলো, কেন ‘মরিবার হলো তার সাধ’, তার কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে কবি লিখেছেন-

“অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়-

আরো এক বিপন্ন বিস্ময়

আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে

খেলা করে;”

আত্মহত্যার কারণটি এখানে সুস্পষ্ট নয়। শুধু এইটুকুই বোঝা যায়, অর্থ, কীর্তি, স্বচ্ছলতার উর্ধ্বে রক্তের ভিতরের কোনো এক ‘বিপন্ন বিস্ময়’ ব্যক্তিটিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু এই ‘বিপন্ন বিস্ময়’ আসলে কী?

‘বোধ’ কবিতায় কবি লিখেছিলেন—

“স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়- কোন্ এক বোধ কাজ করে

মাথার ভিতরে।”

‘বোধ’ কবিতায় বর্ণিত এই মানসিক বোধ বা অস্থিরতার কারণেই সকলের মধ্যে, স্বাভাবিক-স্বচ্ছল জীবনের মধ্যে বাস করেও বিশেষ বিশেষ  ব্যক্তিসত্তা ভিতরে ভিতরে সব কিছুর থেকে আলাদা হয়ে পড়ে এবং মৃত্যুকে অলিঙ্গন করতে বাধ্য হয়।

দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও কবির ব্যক্তিজীবনের আশাহীনতা, বিষাদময়তা, বিবাহিত জীবনের ব্যর্থতা, আর্থিক দুর্দশা প্রভৃতি মিলেমিশে জীবনে একটা ব্যর্থতার বোধ গড়ে ওঠে এবং সেই বোধ থেকে মুক্তির প্রয়াস হিসেবে কবি এই কবিতাটি রচনা করেছেন। তবে কবি আত্মহত্যার পথকে বেছে নিতে চাননি, তাইতো আত্মঘাতী নায়কের চারপাশে ‘জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার’-এর ছবি তুলে ধরেছেন। কবি লিখেছেন-

“তবুও তো পেঁচা জাগে;

গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে আরেকটি প্রভাতের ইশারায়- অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।”

এই তো সংগ্রামী জীবনের ছবি। জীবন ও মৃত্যুকে পাশাপাশি বসিয়েছেন কবি। মানুষ জীবনের প্রত্যাশী। ‘জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার’ শূন্য করার মধ্যে যে ভোগের বাসনা রয়েছে, সাধারণ মানুষ এই জীবনের অংশীদার হলেও ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার নায়ক এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী। তাই তাকে আত্মহত্যা করতে হয়। যারা জীবনের ভোগসুখে মেতে ওঠে, তাদের কাছে এই মৃত্যু অর্থহীন মনে হতে পারে, কিন্তু কবি এই মৃত্যুকে পরিত্রাতা রূপে, জীবনের সদর্থক দিক রূপে দেখিয়েছেন।

একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, জীবনের মতো মৃত্যুও কখনো কখনো কাম্য হয়ে ওঠে, হয়তো সেক্ষেত্রে এই মৃত্যুই জীবনের জয়ধ্বনি। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় একই সঙ্গে জীবন ও মৃত্যু- উভয়ের জয়ধ্বনি ঘোষণা করেছেন।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Application of national building regulations to floors. Tushar enterprises pen raigad. Bespoke kitchens dm developments north west.