জীবনানন্দের কবিতার মধ্যে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ- ইতিহাস চেতনা ও সময়চেতনা। জীবনানন্দের সময় ও ইতিহাস চেতনার প্রতিনিধি স্থানীয় একটি কবিতা ‘১৯৪৬-৪৭’। ভারতবর্ষের ইতিহাসে ১৯৪৬-৪৭ সালের সময়কাল একই সঙ্গে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশায় পরিপূর্ণ। চারটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই সময়কালের মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করছিল— ১৯৪৬-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা, দেশভাগ এবং উদ্বাস্তু সমস্যা। মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছিল- কেউ কাউকে বিশ্বাস করতো না, ভালোবাসতো না, সকলেই স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিল। ব্যথিত কবি সেই অন্ধকার সময় থেকে আলোর পথে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য রচনা করেছেন ‘১৯৪৬-৪৭’ কবিতাটি।
কবিতার শুরুতেই কবি সমকালীন মানুষের জটিল মানসিকতার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন “দিনের আলোয় ওই চারিদিকে মানুষের অস্পষ্ট ব্যস্ততা”। আলোর মধ্যে অস্পষ্টতা অর্থাৎ মানুষের মনের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা লোভ-হিংসা-স্বার্থপরতার অন্ধকার জগতে তো কোনোদিন আলো পৌঁছায় না। তবে তার কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায় মানুষের কাজকর্মে। তাই এই মনোজগত পুরোপুরি অন্ধকার নয়, অস্পষ্ট।
পথে-ঘাটে, ট্রাম লাইনে, ফুটপাতে সর্বত্র ব্যস্ত মানুষের যাতায়াত। সকলেই ছুটে চলেছে। কারণ কোথাও কোনো বাড়ি নিলামের সংবাদ ছড়িয়েছে অথবা আসবাবপত্র। সকলেই সেই সকল জিনিসকে গ্রহন করতে চায়। কিন্তু সবাই তো পারে না- “বহুকে বঞ্চিত করে দু’জন কি একজন কিনে নিতে পারে।” কবির মনে হয়েছে ঐ দু-একজনের হাতেই আছে ক্ষমতার শাসন। যার জোরে তারা সবকিছুই গ্রহণ করে নেয়। আর বাকি সব মানুষেরা ব্যর্থ হয়ে চিরতরে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। যারা পায়, তারা সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষ, তাদের পাওয়ার পেছনে থাকে চক্রান্ত, ছলনা, শঠতা। জীবন থেকে কিছু না পাওয়া অধিকাংশ মানুষের ব্যর্থ জীবনভার কবিকে ব্যথিত করে। তিনি তাদের হয়ে সামান্য এইটুকু প্রত্যাশা করেছেন—
“তাহলে মৃত্যুর আগে আলো অন্ন আকাশ নারীকে কিছুটা সুস্থির ভাবে পেলে ভালো হ’তো।”
সাধারণ মানুষের সামান্য এই চাওয়াটুকু তো চিরকালের। অষ্টাদশ শতকের কবি ভারতচন্দ্রের ঈশ্বরী পাটনীও তো সন্তানের জন্য দেবীর কাছে দুধ-ভাতের প্রার্থনা জানিয়েছিল। দেবী ঈশ্বরীর প্রার্থনা পূরণ করেছিলেন কিনা জানা নেই; তবে একালের সাধারণ মানুষের নূন্যতম চাহিদাটুকু পূরণ হয়
না। শুধু নগর নয়, বাংলার লক্ষ লক্ষ গ্রামও সেদিন নিরাশার ডুবে ছিল। কবি রূপসী বাংলার অন্ধকারকে কেশবতী কন্যার সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং আক্ষেপ করেছেন, সেই কেশবতী কন্যার খোঁপা বেঁধে দেবে কে? সে তো “আলুলায়িত হয়ে চেয়ে থাকে- কিন্তু কার তরে?” এখানে এসেছে মহাভারতের অনুষঙ্গ। দুঃশাসনের হাতে অপমানিত হওয়ার পর দ্রৌপদী অলুলায়িত হয়ে থাকতো। প্রতিজ্ঞা করেছিল, যতদিন ভীম দুঃশাসনের রক্ত হাতে মেখে তার খোঁপা বেঁধে না দেবে, ততদিন সে মুক্তকেশী হয়ে থাকবে। কে বাংলাকে দুঃশাসনের হাথ থেকে মুক্ত করবে কোন ভীম? এখানে তো কোনো “হাত নেই- কোথাও মানুষ নেই”। এই ‘হাত’ আসলে কাজের হাত। বাংলা আজ কর্মহীন, শ্রীহীন। এখানে কোনো আশার আনন্দ নেই, জীবনের সৌন্দর্য নেই- ‘নিভে গেছে সব’। অথচ একদিন তো ছিল। নবান্নের উৎসবে গ্রাম-বাংলা মেতে উঠতো। নতুন চালের গন্ধে ভরে উঠতো গ্রাম। কাক-পাখিরা উড়ে আসতো। গ্রাম্য বধূরা শাঁখ বাজাতো, পুরুষেরা ধানের অদ্ভুত রস খেয়ে চাঁদিনী রাতে নৃত্যে মেতে উঠতো। হৃদয়ের বিনিময় হতো। কিন্তু এখন সবই স্বপ্ন। কিছু স্বার্থপর মানুষের চক্রান্তে আর সাম্প্রদায়িকতার চাপে গ্রামবাংলাও ধ্বংস হয়ে গেছে।
অতীত ও বর্তমানের তুলনা করতে গিয়ে কবি জানিয়েছেন- “ওরা খুব বেশি ভালো ছিল না; তবুও আজকের মন্বন্তর দাঙ্গা দুঃখ নিরক্ষরতায় অন্ধ শতছিন্ন গ্রাম্য প্রাণীদের চেয়ে পৃথক আর এক স্পষ্ট জগতের অধিবাসী ছিল।”
এখন সবকিছুই অস্পষ্ট। বিদ্বেষ, সন্দেহ, হিংসা মনুষ্যত্বকে নষ্ট করে দিয়েছে। কেউ কাউকে মনের কথা খুলে বলে না। এইসব দেখেই কবির মনে হয়েছে- “সৃষ্টির মনের কথা মনে হয়- দ্বেষ।” মানুষের মতো প্রকৃতিও আজ হিংস্র। ঝর্ণার জল লাল হয়ে যায় নিহত প্রাণীর রক্তে, বাঘ আজো হরিণের পিছু ধায়। ছেচল্লিশের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় কবি মনুষ্যত্বের চূড়ান্ত অবমাননায় ক্ষুব্ধ, ব্যথিত হয়েছিলেন। মানুষের হাতে মানুষের মৃত্যু তো আসলে ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দু। এই দ্বন্দ্বের দায় তো কবিরও। তাই তিনি বিক্ষুব্ধ চিত্তে বলেন-
“মানুষ মেরেছি আমি- তার রক্তে আমার শরীর ভরে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার
ভাই আমি”
দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে তো সাধারণ শ্রেণির মানুষ- যারা ছেঁড়া জুতো পায় দেয়। সেই সব ইয়াসিন, হানিফ, মহম্মদ, মকবুল, গগন, বিপিন, শশীর দল রক্তনদীর স্রোতে ঘুমিয়ে পড়েছে। সভ্যতার এই চূড়ান্ত সর্বনাশে কবি হাহাকার করে বলেছেন- “কেউ নেই, কিছু নেই সূর্য নিভে গেছে।” কবি এখানে চূড়ান্ত নিরাশাবাদী। আসলে আধুনিক সভ্যতার কৃত্রিমতায় তিনি অসহায় বোধ করেছিলেন। বিজ্ঞান নির্ভর এই সভ্যতায় মানুষ আর প্রাণের থেকে কথা বলে না, অনুভূতির ভাষা ব্যবহার করে না। প্রকৃত জ্ঞান আর নেই পৃথিবীতে, “জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই।”
জীবনানন্দ তিমিরবিলাসী ছিলেন না, ছিলেন তিমিরবিনাশী। বর্তমান মানবসভ্যতার অন্ধকারকে স্বীকার করে নিয়েও তিনি এক ‘মহানুভব ব্যাপ্ত অন্ধকার’-এর কথা বলেছেন। মাতৃগর্ভের অন্ধকারের মতো সে অন্ধকার মহানুভব। সে অন্ধকারে এ জীবন ধীরে ধীরে বীতশোক হয়, হৃদয়ে জাগে স্নিগ্ধতা। কোনো অন্ধকারই অনন্ত হতে পারে না। আসলে অনন্ত তো খণ্ডেরই সমাহার। খণ্ড রাত্রি অতিক্রম করে অখণ্ড দিনের সূচনা হবেই। ছেচল্লিশের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার পরেই তো এসেছিল সাতচল্লিশের মুক্তির আলো। সুতরাং, মানুষ অন্ধ দুর্দশা থেকে স্নিগ্ধ আলোর দিকে পুনরায় ফিরে যাবে, এখানেই কবিতাটির মূল বক্তব্য নিহিত রয়েছে।