জীবনানন্দের কবিতার মধ্যে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ- ইতিহাস চেতনা ও সময়চেতনা। ইতিহাস চেতনা ও সময়চেতনা বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থে। এই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘রাত্রি’ কবিতায় কবি দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালের কলকাতার নাগরিক
জীবনের অসহায়তা, মনুষ্যত্বহীনতাকে অত্যন্ত সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। জীবনানন্দের কবিতায় ‘রাত্রি’ শব্দটি বহু ব্যবহৃত এবং তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ। শব্দটি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তিনি মানবসভ্যতার এবং মানবমনের প্রকৃতিকে নির্দেশ করেছেন। আলোচ্য কবিতার শুরু থেকেই মানবসভ্যতার চরম বাস্তবতার ছবিটি ফুটিয়ে তুলেছেন কবি-
“হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল;”
এ ছবি তো কলকাতা শহরের। নাগরিক সভ্যতার মধ্যে আজ প্রেম- প্রীতি-করুণা-মানবিকতা নেই বলেই কুষ্ঠরোগীর প্রতি মমতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো কেউ নেই। হাইড্র্যান্ট ফেঁসে গিয়ে রাস্তা প্লাবিত হচ্ছে নোংরা জলে। নোংরা জলের বিস্তার আসলে মানবতার অবক্ষয়কেই চিহ্নিত করছে। নগরীর বুকে গভীর রাতের অন্ধকারে চোর-ডাকাত-গুণ্ডাদের কাজকর্ম বৃদ্ধি পায়। অসামাজিক এই কাজকর্ম যুগগত ব্যাধির পরিচয় বহন করে। যন্ত্রনির্ভর নাগরিক সভ্যতার মানুষ বিচার-বোধহীন হয়ে নিজস্বতাকে হারিয়ে ফেলেছিল।
শুধু যুদ্ধ নয়, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির বাণিজ্যিক অর্থনীতিও মানুষের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছিল। গ্যাস ল্যাম্পের মায়াবী আলোতে তিনটি রিকশা মিশে যায় অর্থাৎ মোটরকারের যুগে গতিহীন রিকশা তো মূল্যহীন।
এরপর কবি ফিয়ার লেন ছেড়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে বেন্টিঙ্ক স্ট্রীটের টেরিটি বাজারে গিয়ে দাঁড়ালেন। সেখানে- “চীনেবাদামের মতো বিশুদ্ধ বাতাস।” এখানে কবি এসে দাঁড়িয়েছেন এক আশাহীনতার জগতে। অর্থনীতির মূল ভারকেন্দ্র, এখানে অর্থের দাপট আর মুনাফার লোভে মানুষ হারিয়েছে তার মনুষ্যত্ব।
“মদির আলোর তাপ চুমো খায় গালে”- কবির এই বক্তব্যে নগর সভ্যতার প্রলোভন লুকিয়ে রয়েছে। এখানে কোনো রোমান্টিক প্রেমের প্রকাশ নেই। কেরোসিন, কাঠ, গালা, চামড়া প্রভৃতি পণ্যসামগ্রী টেরিটি বাজারের অর্থনীতিকে ধরে রেখেছে।
এ যুগে শাশ্বত মূল্যবোধ বলে কিছু নেই। মানুষ আর অমৃতের পিপাসু নয়, সে চায় ক্ষণসুখ, জৈব কামনার তৃপ্তি। বৈদিক নারী মৈত্রেয়ীর অমৃতময় বাণীগুলি আজ অর্থহীন। এখন পশুশক্তি আর অর্থশক্তিই শেষ সত্য।
লোভী এই বাণিজ্যিক সভ্যতায় মনুষ্যত্বের অবক্ষয় সত্য, কিন্তু শেষ সত্য নয়। তাইতো কবি শুনেছেন, উপরের জানালার পাশে বসে এক ইহুদী নারীর গান গাওয়া। গান তো মানুষের হৃদয়ের কোমল ভাবকে ব্যক্ত করে। পিতৃলোক তথা পূর্বপুরুষেরা সেই গান শুনে হাসে। কারণ, মানুষের হৃদয় তো আজ পণ্যের মতোই বিক্রীত।
ফিরিঙ্গি যুবকেরা প্রেম বোঝে না, বোঝে কাম। বিগত যৌবনা লোল নিগ্রোও সেই কাম ভাবনায় তাড়িত। কিন্তু তার দেহ যে আর জাগে না। তাই ফিরিঙ্গি যুবকদের দেখে সে হাসে। তার হাসি বিদ্রূপের নয়, দুঃখের। হয়তো কিছু মনুষ্যত্ব এখনও তার মধ্যে আছে। একদিকে মনুষ্যত্ব, অপরদিকে প্রবৃত্তি- এই দুয়ের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে তাই গেরিলার মতো মনে হয়েছে কবির।
বৃদ্ধ লোল নিগ্রোটি তো জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে। অনেককিছু দেখেছে সে। তার মনে হয় ‘নগরীর মহৎ রাত্রি’ আসলে ‘লিবিয়ার জঙ্গল’। অর্থাৎ আধুনিক নগর সভ্যতার সঙ্গে হিংস্র পশুসমাজের কোনো তফাৎ নেই। মানুষ শুধু কাপড় পড়ে, আর জন্তু ভিতরে বাইরে হিংস্রতাকে প্রকাশ করে। তবে লজ্জাবশত মানুষের কাপড় পড়ার মধ্যেই যেন একটা ইতিবাচক মনোভাব লুকিয়ে রয়েছে। এই লজ্জাই একদিন মানবসভ্যতাকে শুভবোধে উদ্বুদ্ধ করবে।