‘তপস্বী তরঙ্গিণী নাটক’ এর মূল আখ্যান সম্পর্কে – আলোচনা কর।

ইংরেজী সাহিত্যের সুপন্ডিত বুদ্ধদেব বসু পরিণত বয়সে দেশী-বিদেশী নানা কাব্য-পুরাণের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এ সময়ে তাঁর চেতনায় একদিকে যেমন বোদলেয়ারের নিয়তিবাদ ও বিষাদ প্রভাব বিস্তার করেছিল তেমনি অন্যদিকে বিগত পাঁচ দশকের শিকড়হীন সাহিত্য চর্চার ধারায় তিনি সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। এইপর্বে শিকড়হীন সাহিত্য-ধারার বিকল্প পরিপুরক খুঁজতে তিনি যাত্রা করলেন প্রাচীন ঐতিহ্যের দিকে। তাঁর ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ নাটকে তাই তিনি মহাভারতীয় কাহিনী অনুসরণ করলেন। কারণ তাঁর একান্ত উদ্দেশ্য ছিল ঋষ্যশৃঙ্গ মিথটিকে আধুনিক জীবন- জিজ্ঞাসার প্রেক্ষাপটে পুনঃসৃজিত করা। নাটকের ভূমিকা অংশে তাই তিনি লিখেছেন: “এই নাটকের অনেকখানি অংশ আমার কল্পিত, এবং রচনাটি শিল্পিত- অর্থাৎ, একটি পুরাণ কাহিনীকে আমি নিজের মনোমতো করে নতুন ভাবে সাজিয়ে নিয়েছি, তাতে সঞ্চার করেছি আধুনিক মানুষের মানসতা ও দ্বন্দ্ব বেদনা। বলাবাহুল্য, এ ধরণের রচনায় অন্ধভাবে পুরাণের অনুসরণ চলে না; কোথাও ব্যতিক্রম ঘটলে তাকে ভুল বলাটাই ভুল। আমার কল্পিত ঋষ্যশৃঙ্গ পুরাকালের অধিবাসী হয়েও মনস্তত্ত্বে আমাদেরই সমকালীন।”

নাট্যকার বুদ্ধদেব বসুর কল্পনা-সমৃদ্ধ এবং চার অঙ্কে বিভক্ত ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ নাটকের কাহিনীটি সংক্ষেপে এরকম: দীর্ঘকাল অনাবৃষ্টির ফলে অঙ্গদেশের চারদিকে দুর্ভিক্ষের হাহাকার উঠেছে। গাঁয়ের মেয়েরা রাজদ্বারে এসে বিলাপধ্বনি তুলছে। রাজদূতেরা দেশে দেশে ঘুরে যে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করেছিলেন পথিমধ্যে তা রহস্যজনকভাবে লুন্ঠিত হয়েছে। তাই এই দুর্দিনে রাজপুরুষেরা দৈবজ্ঞের শরণাপন্ন হয়েেেছন। দৈবজ্ঞের নির্দেশে রাজদূতেরা রাজমন্ত্রীর কাছে নিয়ে এসেছেন রাজ্যের অভিজ্ঞ গণিকা লোলাপাঙ্গী ও তার সুন্দরী কন্যা তরঙ্গিণীকে। কারণ পরম সাহসিনী এই দ’জন গণিকা ছাড়া আর কারো সাধ্য নেই তপোবন থেকে অপাপবিদ্ধ, তেজস্বী, ব্রহ্মচারী ঋষ্যশৃঙ্গকে মোহিত করে অঙ্গদেশে নিয়ে আসে। আর, ঋষ্যশৃঙ্গের কৌমার্যনাশ করা ছাড়া অঙ্গদেশে বৃষ্টিপাতের কোন সম্ভাবনা নেই–এই হ’ল দৈবজ্ঞের নির্দেশ।

দ্বিতীয় অঙ্কে বারাঙ্গনা তরঙ্গিণী নানা কৌশলে ও ছলনার আশ্রয়ে ঋষ্যশৃঙ্গের কামবোধ জাগিয়ে তুলে তাকে কামাতুরা অবস্থায় অঙ্গদেশের রাজধানী চম্পা নগরে নিয়ে আসার কাজটি সম্পন্ন করেন। ঋষ্যশৃঙ্গ তরঙ্গিণীর সঙ্গে নগরে প্রবেশ করা মাত্রই সেখানে অলৌকিকভাবে বৃষ্টি নামল। নেপথ্যে ধূনিত হ’তে লাগল মেয়েদের আনন্দিত স্বর—“বৃষ্টি! বৃষ্টি! বৃষ্টি!” এরপর ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গে রাজকুমারী শান্তার বিবাহ হ’ল এবং তরঙ্গিণী ঋষ্যশৃঙ্গের জন্য ফাঁদ পেতে নিজেই সেই ফাঁদে আটকা পড়লেন। বুদ্ধদেব বসু জানিয়েছেন, ঋষ্যশৃঙ্গের মধ্যে জেগে উঠল ‘ইন্দ্রিয় লালসা’ এবং তরঙ্গিণীর মধ্যে সঞ্চারিত হ’ল ‘রোমান্টিক প্রেম।’ তাদের পারস্পরিক আকর্ষণের নিগুঢ় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় দু’জনের আত্ম-জাগরণ ঘটল, তাদের দু’জনের চোখেই ফুটে উঠল অনন্য এক স্বপ্ন। তরঙ্গিণী কেবলই সন্ধান করতে লাগলেন তার সেই মুখশ্রী ঋষ্যশৃঙ্গ প্রথম দর্শনে যে দেবদুর্লভ মুখশ্রীর কথা তরঙ্গিণীকে বলেছিলেন। অন্যদিকে, ঋষ্যশৃঙ্গও তার বিবাহিতা পত্নীর সহবাসে কোনো তৃপ্তি পেলেন না; যুবতি তরঙ্গিণীই যে তার ঈপ্সিতা। তিনি স্বপ্নে, জাগরণে সন্ধান করতে লাগলেন তরঙ্গিণীর সেই নারীরূপ যে নারীরূপের বিভা তাকে শুধু নারী সর্ম্পকে সচেতন করে তোলে নি- তার নিজস্ব পৌরুষ সর্ম্পকেও তাকে অবহিত করে তুলেছিল। নারী সংস্পর্শে পুরুষের চিত্ত জাগরণের ছবি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে ঋষ্যশৃঙ্গের সংলাপে: “নারী।নারী, নারী। নূতন নাম। নূতন রূপ…. নূতন এক জগৎ।…আমি অস্নাত থাকব তোমার স্পর্শের শিহরণ যাতে জাগ্রত থাকে।”২ ঋষ্যশৃঙ্গ ও তরঙ্গিণী আবার এমন এক সময়ে মিলিত হলেন যখন রাজকুমারী শান্তার প্রেমিক মন্ত্রী-পুত্র অংশুমান ও তরঙ্গিণীর প্রেমিক চন্দ্রকেতু লোলাপাঙ্গীর সঙ্গে নিজেদের দাবী ও প্রার্থনা নিয়ে ভাবী যুবরাজ ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। অবশ্য, ততদিনে এক বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে, ঋষ্যশৃঙ্গের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছে। নাট্যকার বুদ্ধদেব বসু ঋষ্যশৃঙ্গের পুরাণ কাহিনীর সঙ্গে তাঁর পরিকল্পিত জীবন-কাহিনীর পরিণতিকে এভাবে যুক্ত করলেন যে, ঋষ্যশৃঙ্গ শান্তাকে তার কৌমার্য প্রত্যর্পণ করলেন এবং শান্তার পূর্ব-প্রেমিক অংশুমানের হাতে তাকে ও পুত্রকে অর্পণ করে দেহ সর্বস্ব ভোগ-বাসনা থেকে দেহাতীত অনুভবে পুণ্যের পথে নিষ্ক্রান্ত হলেন। “ঋষ্যশৃঙ্গ শান্তাকে তাহার কৌমার্য প্রত্যর্পণ করিল। প্রেমহীন বিবাহের বন্ধন হইতে তাহাকে মুক্তি দিল।…এই মুক্তিদানের মধ্যে ঋষ্যশৃঙ্গের উদারতা এবং লেখকের আধুনিক সংস্কারমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। আর, ঋষ্যশৃঙ্গের আজ্ঞায় তরঙ্গিণীরও নিষ্ক্রমণ হ’ল একাকী। নাটকের চতুর্থ অঙ্কে আমরা ঋষ্যশৃঙ্গ ও তরঙ্গিণীর কথোপকথনে নাট্যকারের এই জীবন-জিজ্ঞাসার চিহ্ন খুঁজে পাই। ঋষ্যশৃঙ্গ ও তরঙ্গিণীর কথোপকথন এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়: 

তরঙ্গিণী। (এগিয়ে এসে) তুমি কি আশ্রমে ফিরে যাচ্ছনা?

ঋষ্যশৃঙ্গ।  কেউ কি কোথাও ফিরে যেতে পারে, তরঙ্গিণী।…..আমার

সেই আশ্রম আজ লুপ্ত হ’য়ে গিয়েছে। সেই আমি লুপ্ত

হ’য়ে গিয়েছি। আমাকে সব নতুন করে ফিরে পেতে

হ’বে। আমার গন্তব্য আমি জানি না, কিন্তু হয়তো তা তোমারও গন্তব্য। যার সন্ধানে তুমি এখানে এসেছিলে হয়তো তা আমারও সন্ধান। কিন্তু তোমার পথ তোমাকেই খুঁজে নিতে হ’বে, তরঙ্গিণী।

তরঙ্গিণী।   প্রিয়, আমার প্রিয়তম, আমি কি আর কোনদিন তোমাকে দেখবো না?

ঋষ্যশৃঙ্গ ।  আমাকে বাধা দিয়ো না, তরঙ্গিণী। তুমি তোমার পথে যাও। হয়তো জন্মান্তরে আবার দেখা হবে।

এখানে বুদ্ধদেব বসু পুরাণ চরিত্রের নবরূপায়ণ ঘটালেন। নাট্যকার নিজেই একদা জানিয়েছিলেন যে, তিনি ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ নাটকটি রচনার প্রেরণা পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘পতিতা’ কবিতা থেকে। এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঋষ্যশৃঙ্গ পুরাণের এক অনামি বারাঙ্গনার জীবনে আশ্চর্য প্রেমের জাগরণ ঘটিয়ে তাকে একজন নারীতে রূপান্তরিত করেছেন। এই কবিতায় পতিতা রাজমন্ত্রীর কাছে তার মনের তীব্র দহন ব্যক্ত করে জানিয়েছেন-

অধম নারীর একটি বচন

রেখো হে প্রাজ্ঞ স্মরণ করে

বুদ্ধির বলে সকলি বুঝেছ,

দু-একটি বাকি রয়েছে তবু

দৈবে যাহারে সহসা বুঝায়

সে ছাড়া যে কেহ বোঝে না কভু,

আর বুদ্ধদেব বসু এই নারীকেই বিশেষ নাম দিয়ে তাকে ব্যক্তিত্বময়ী নারীতে রূপান্তরিত করেছেন; কামকে পরিণত করেছেন প্রেমে। তাই তাঁর বন্দিনী নারী বিধাতাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন-“তুমি মোরে দিয়েছ কামনা, অন্ধকারে অমারাত্রি সম, তাহে আমি গড়িয়াছি প্রেম, মিলাইয়া স্বপ্নসুধা মম।’”৪

এই অনুরূপ অনুভূতির প্রতিফলন ঘটেছে বুদ্ধদেব বসুর ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ নাটকের তরঙ্গিণীর মধ্যে।

ভারতীয় ঐতিহ্যবোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ঋষ্যশৃঙ্গ মিথটি মানব জীবন-বৃত্তের একটি মৌলিক সত্য। দেহ এবং দেহগত কামনা-বাসনার স্তরপরম্পরা অতিক্রম করে বুদ্ধদেব এই নাটকে রোমান্টিক প্রেমের ধারণা প্রকাশ করেছেন। তিনি মনে করেন, নারী-পুরুষের পরস্পর আকর্ষণ ও কামনার উদ্দীপন বিশ্বমানবের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। আর সেই অর্থেই প্রেমের মূল ‘শিকড়’ রূপে বুদ্ধদেব বসু রূপান্তরধর্মী ‘কাম’-এর কথা বলেছেন। সমস্ত জীবনব্যাপী সাহিত্য সাধনায় বুদ্ধদেব বসু যে কামচেতনার সমৃদ্ধ স্বরূপ উদ্‌ঘাটন করেছেন, সেই জীবনতৃষ্ণার প্রকাশ ঋষ্যশৃঙ্গ ও তরঙ্গিণীর মধ্যেও ঘটেছে। নারী-পুরুষে ভেদজ্ঞানহীন ঋষ্যশৃঙ্গের মধ্যে কামনার উদ্রেক

ঘটিয়েছে তরঙ্গিণী; তার মধ্যে জেগেছে কামসম্ভূত প্রেম। যেমন, ঋষ্যশৃঙ্গের সংলাপের কিছু অংশ:

“ঋষ্যশৃঙ্গ । (তরঙ্গিণীর মুখে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে; স্বগতোক্তির ধরনে)–তুমি।

তুমি…আমার হৃদয়ের বাসনা, আমার শোণিতের হোমানল। অন্য কেউ নয়, অন্য কিছু নয়।…..তৃষ্ণার্তের যেমন জল, তেমনি আমার চোখের পক্ষে তুমি।”*

যে-নারীর চোখে জীবনের উদ্দীপন শক্তি, তাকে ছাড়া যে আজ ঋষির জীবন ব্যর্থ, ঋষ্যশৃঙ্গকে জীবনের এই দীক্ষাই দিয়েছে তরঙ্গিণী।

তপস্বী ও তরঙ্গিণীর মনে অর্ন্তদ্বন্দ্ব-মথিত প্রেম ও বিরহের কালাতীত জীবন-তৃষ্ণার রূপ স্পষ্ট হ’য়ে উঠেছে; দেহকে কেন্দ্র করেই যে দেহাতীত প্রেমের উত্তরণ ঘটানো যায়, বুদ্ধদেব বসু পাঠক ও দর্শককে তাই অনুভব করিয়েছেন মহাভারতীয় এই কাহিনীর আধুনিক রূপায়ণে। তাঁর একটি উক্তি প্রসঙ্গত স্মরণীয় : “লোকেরা যাকে কাম নাম দিয়ে নিন্দে করে থাকে তারই প্রভাবে দু’জন মানুষ পুণ্যের পথে নিষ্ক্রান্ত হলো– নাটকটির মূল বিষয় হলো এই। দ্বিতীয় অঙ্কের শেষে নায়ক-নায়িকার বিপরীত দিকে পরিবর্তন ঘটলো; একই মুহূর্তে জেগে উঠল তরঙ্গিণীর হৃদয় এবং ঋষ্যশৃঙ্গের হৃদয় লালসা। এই ঘটনার ফলে ব্রহ্মচারীর হলো ‘পতন’ আর বারাঙ্গনাকে অকস্মাৎ অভিভূত করলো ‘রোমান্টিক প্রেম’- যেভাবে রবীন্দ্রনাথের ‘পতিতা’-য় বর্ণিত আছে, সেভাবেই।…তরঙ্গিণী সেই আবেশ আর কাটিয়ে উঠতে পারলে না, তাই চতুর্থ অঙ্কে ঋষ্যশৃঙ্গকে দেখে প্রথমে নিরাশ হলো সে এবারে যেন দ্বিতীয় অঙ্কের ঘটনাটি উল্টে গেলো–অর্থাৎ ঋষ্যশৃঙ্গ চাইলেন তরঙ্গিণীকে ‘ভ্রষ্ট’ করতে, আর তরঙ্গিণী খুঁজলো ঋষ্যশৃঙ্গের মুখে সেই স্বর্গ– যা দ্বিতীয় অঙ্কে ঋষ্যশৃঙ্গ তার মুখে দেখেছিলেন, এবং যার পুনরুদ্ধারে সে বদ্ধপরিকর। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ঋষ্যশৃঙ্গ তরঙ্গিণীকে বুঝিয়ে দিলেন, কোথায় সব মানুষের চরম সার্থকতা।”*

‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ নাটকে বুদ্ধদেব বসু পুরাণের বিনির্মাণ করলেন। নাটকটির আরম্ভ হয়েছে গাঁয়ের মেয়েদের গান দিয়ে; দীর্ঘকাল অনাবৃষ্টির ফলে কাতর মানুষদের জন্য দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে মেয়েরা বৃষ্টি প্রার্থনা করছে। এলিয়ট তাঁর ‘The Waste Land’ কাব্যে এবং J. L. Weston তাঁর ‘Ritual to Romance’-এর কাহিনীর শুরুতেই এক অনুর্বর পোড়োজমিকে হাজির করেছেন; যেখানে ফসল ফলে না— বন্ধ্যা। এলিয়ট ও ওয়েস্টন প্রাচীন কাহিনীর

অবয়বে প্রতিধ্বনিত আধুনিক কালের অবক্ষয়িত যন্ত্রণাজনিত বেদনাকে নতুন ব্যঞ্জনায় প্রতীকী তাৎপর্য দান করেছেন। বুদ্ধদেব বসুও এই নাটকে বন্ধ্যাভূমির প্রেক্ষিতে আধুনিক মানুষের রিক্ত, বিচ্ছিন্ন, শূন্য অবস্থানটিকে দ্যোতিত করেছেন। গাঁয়ের মেয়েদের সঙ্গীত রচনার ক্ষেত্রেও তিনি এলিয়টের ‘Murder in the Cathedral’ নাটকের ‘কোরাস’ সঙ্গীতের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।

শুধু তাই নয়, আদিম সমাজে বহু মিথের জন্ম হয়েছে ফসল ফলানো কিংবা ফসল কাটাকে কেন্দ্র করে। ফসলের সুপ্রজননের (fertility) জন্য সে সমাজে নানা যাদুবিদ্যা-মূলক আচার-আচরণ প্রচলিত ছিল এবং এর প্রধান অঙ্গ হিসেবে একটি পুরুষ ও নারীর মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠান ঘটানো হ’তো। কারণ পুরুষের বীর্য এবং আকাশের বৃষ্টি আদিম মানব সমাজের দৃষ্টিতে একটি পরস্পর পরিপূরক ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত। পুরুষের সংস্পর্শে এসে নারী যেমন সন্তানবতী হয়ে ওঠে, তেমনি বৃষ্টিধারায় স্নাত পৃথিবীও শস্য-শ্যামলা হ’য়ে উঠবে। এই নাটকে ঋষ্যশৃঙ্গের কৌমার্য নাশের জন্য বারাঙ্গনাকে প্রেরণ এবং বারাঙ্গনার ছলনায় আকৃষ্ট হয়ে ঋষ্যশৃঙ্গ অঙ্গদেশের নগরে প্রবেশ করা মাত্র বৃষ্টি-ধারায় স্নাত হ’য়ে ওঠে নগরী। এরপর রাজকুমারী শান্তার সঙ্গে ঋষ্যশৃঙ্গের বিবাহ অনুষ্ঠান। –এই ঘটনা পরম্পরায় বুদ্ধদেব বসু আদিম সমাজের লোকাচার ও ঐতিহ্যমূলকতাকে স্বীকার করে নিয়েছেন এবং সমসাময়িক আধুনিক অবক্ষয়িত জীবন থেকে উর্বরতা সম্পন্ন চিরকালীন জীবনে উত্তরণের কামনার কথাই মেয়েদের আকুল হাহাকারে ব্যঞ্জিত করে তুলেছেন।

আবার ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ নাটকে মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ঋষ্যশৃঙ্গ ও তরঙ্গিণী হলেও অপরাপর চরিত্রগুলিও এখানে সমান প্রাসঙ্গিকতা লাভ করেছে। শান্তা, অংশুমান, লোলাপাঙ্গী, চন্দ্রকেতু–প্রতিটি চরিত্র যেন একে অপরের বিপ্রতীপে দাঁড়ানো জীবন সমগ্রতার এক একটি পরিপুরক সত্তা। তাই নাটকের শেষে লোলাপাঙ্গী চন্দ্রকেতুকে বলেছেন–“আমি এখনো বৃদ্ধা হই নি।” লোলাপাঙ্গী ও চন্দ্রকেতুর জীবনের এই ফ্রয়েডিয় পরিণতি কাম ও যৌনতায় দোলায়িত আধুনিক জীবনের পরিচায়ক হয়ে উঠেছে। পুরাণের কাহিনীতে অঙ্গদেশের দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে রাজা লোমপাদের ব্রাহ্মণের সঙ্গে মিথ্যাচার এবং পুরোহিতের প্রতি অত্যাচারের অভিযোগ রয়েছে। আর, বুদ্ধদেব বসু তাঁর নাটকে আধুনিকতার আবহটি অক্ষুন্ন রাখার জন্য দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে শাসক গোষ্ঠীকে দায়ী করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাই, নাটকটির প্রথম অঙ্কে প্রথম দূত পাপীর পরিচয় উদ্‌ঘাটনের চেষ্টা করলে দ্বিতীয় দূত তাকে বলেছে: “থামো, অতিকথন হয়ে যাচ্ছে। রাজদূতের মুখে রাজদ্রোহ কি সমীচীন?”— মোটকথা, বুদ্ধদেব বসুর ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ নাটকের চরিত্রগুলি জীবনের অজস্র স্রোত-প্রতিস্রোতের চলমানতাকে প্রতিবিম্বিত করেছে।

“নাট্যকার বুদ্ধদেব বসু তাঁর এই নাটকে একটি সাংকেতিক জীবন-রহস্যপূর্ণ মিথ কাহিনীর ব্যবহার করে আধুনিক সময়ের ব্যক্তিচিন্তাকে চিরকালীন ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত করে আবহমান কালের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন।” এর ফলে, তাঁর চরিত্রগুলি বর্তমান থেকে দূরবর্তী অতীত কালের হয়েও আধুনিক মনস্তত্ত্ব সম্মত চিরকালীন মানব চরিত্র হয়ে উঠেছে।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Why national building regulations. Gpj nxtgen infrastructure private limited. Top 5 best local builders merchants – fylde & wyre dm developments north west.