রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোটগল্পে অবহেলিত মানবজীবন, সমাজ, এবং মানবিক মূল্যবোধের উপর প্রধান দৃষ্টিকোণ দেন। তার লেখা ছোটগল্পগুলি সাধারণভাবে মানুষের মানসিক ও আধ্যাত্মিক প্রস্তুতির কথা বলে এবং সমাজের বিভিন্ন মৌলিক সমস্যার প্রতি তার উদ্দীপনা করে।রবীন্দ্রনাথের হাতেই বাংলা ছোটগল্পের সার্থক রূপটি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ‘সাধনা’ পত্রিকায় তিনি ছোটগল্প লিখতে শুরু করেন। তার আগেও অবশ্য তিনি গল্প লিখেছেন। তবে বাংলা ছোটগল্প যে পাশ্চাত্য গল্পের কাছে ঋণী, এমন কি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এডগার অ্যালান পো-র বিদেশি সাহিত্যিকের সৃষ্টির কথা সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন, এ তথ্য প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু বাংলা ছোটগল্পের সেই প্রাথমিক যুগে বিদেশি সাহিত্যের সাহায্য গ্রহণ না করে উপায় ছিল না। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প-রচয়িতা প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এ সম্পর্কে আলোচনা করে বাংলা ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ কৃতিত্বের কথা স্মরণ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “উপন্যাসের মত, ছোটগল্প জিনিসটাকেও আমরা পশ্চিম হইতে বঙ্গসাহিত্যে আমদানি করিয়াছি। ছোটগল্পের জন্ম সুদূর পশ্চিম আমেরিকায়। মার্কিনেরা বড় ব্যস্ত জাতি—তাহাদের নিশ্বাস ফেলিবার অবকাশ নাই—তাই বোধ হয় সে দেশে ছোটগল্পের জন্ম হইয়াছিল। আমেরিকা হইতে ইউরোপে এবং তথা হইতে আনীত হইয়া এখন ইহা মহিয়সী বঙ্গবাণীর চরণে নৃপুরস্বরূপ বিরাজিত, মৃদু মধুশিজ্ঞনরবে বঙ্গীয় পাঠকের চিত্ত বিনোদন করিতেছে। পূর্বকালে বঙ্গদর্শনে বঙ্কিমবাবু তিনটি ছোটগল্প লিখিয়াছিলেন। সঞ্জীববাবু দুই একটি লিখিয়াছিলেন বলিয়া স্মরণ হইতেছে। কিন্তু সেগুলি আকারে ছোটমাত্র, নচেৎ উপন্যাসেরই লক্ষণাক্রান্ত। বর্তমান সময়ে ছোটগল্পের মধ্যে যে একটা নিজস্ব বিশেষত্ব আছে, তাহা সেগুলিতে ছিল না। ছোটগল্প বলিতে আমরা যাহা বুঝি, শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ই তাহা বঙ্গসাহিত্যে প্রথম প্রবর্তন করিয়াছিলেন।” অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্প যে অধিকতর কাব্যধর্মী ও ব্যঞ্জনাপ্রধান, তার কারণ সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের বিশেষ কল্পনাদৃষ্টির প্রভাব। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প সম্পর্কে আলোচনা করে তার বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথের উৎসুক্য প্রধানতঃ চরিত্রসৃষ্টিতে ও জীবন পর্যবেক্ষণে নহে, জীবনের মধুর, কাব্যময় পরিবেশে চারিত্রিক লীলার স্ফূর্তি ও বিকাশে। তত্ত্বের দ্রবীভূত রস ও সৌন্দর্যরূপেই তাঁহার প্রধান আকর্ষণ। অনেক সময়ে গল্পের ছোটখাপে সাঙ্কেতিকতার তরবারির দীপ্তি ভাস্বর হইয়া উঠিয়াছে। ‘সমাপ্তি’, ‘মধ্যবর্তিনী’, ‘দৃষ্টিদান’, প্রভৃতি গল্প যেন এক একটি গীতিকবিতার রেশে অনুরণিত, জীবনসত্যের এক একটি লীলারহস্য যেন ঘটনার পত্রাবরণের পদ্মের ন্যায় বিকশিত। বাঙালী জীবনের ছোটখাট আশা-নৈরাশ্যের দ্বন্দ্ব, আনন্দ-বেদনার মৃদু স্বপ্ন কল্পনা ও সুকোমল বাস্তব স্পর্শ, অন্তরের সুকুমার কাব্যনির্যাস যেন এই গল্পগুলিতে কখনও কৌতুক স্নিগ্ধ, কখনও অশ্রু-করুণ পরিণতিতে ক্লান্ত অঙ্গসৌষ্ঠব লাভ করিয়াছে।
“রবীন্দ্রনাথের শেষজীবনের গল্পগুলিতে কবিদৃষ্টির পরিবর্তে তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণদৃষ্টিই প্রধান হইয়া উঠিয়াছে। সমাজ-সমস্যা, আদর্শ-বৈষম্যমূলক মতবাদ, অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সহিত পারিপার্শ্বিকের অসামঞ্জস্য ও সংঘর্ষ যুদ্ধ্যোদত সঙ্গিনের ন্যায় মাথা উঁচাইয়া দাঁড়াইয়াছে ও পূর্ববর্তী পর্যায়ের ছোটগল্পের ভাব-সুষমা ও আঙ্গিক পরিপাট্য ক্ষুণ্ণ করিয়াছে। সমস্যা-কণ্টকিত, বাদ-প্রতিবাদে উয় সংগ্রামী আবহাওয়ার ঝটিকা সংক্ষুব্ধ পটভূমিকায় সন্নিবিষ্ট এই ছোটগল্পগুলি যুগচিত্তের উত্তেজিত অসঙ্গতিবোধের যথাযোগ্য প্রকাশ। এখানে সৌন্দর্যতন্ময়তার পরিবর্তে আছে আঘাত-তৎপরতা, ভাবাদর্শের পরিবর্তে আছে উগ্র বাস্তব-চেতনা, আত্মার গভীরে অনুপ্রবেশের পরিবর্তে আছে উপরিভাগের রেখা বৈচিত্র্যের মধ্যে বিচরণ-কুশলতা। ছোটগল্পে যে কাব্যপরিবেশ সৃষ্টি হইয়া ক্রমশ জটিল বস্তুসংস্থান ও তীক্ষ্ণ সমস্যা সকুলতার দিকে ঝুঁকিতেছে, রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্যায়ের গল্পগুলি তাহারই নিদর্শন।”
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলি দু’টি পর্বে বিভক্ত করে আলোচনা করা উচিত। প্রথম পর্বের গল্পগুলিতে পদ্মাতীরবর্তী উত্তরবঙ্গের গ্রামীণ মানুষের জীবনই প্রধানত প্রতিফলিত হয়েছে। সমকালীন জটিল নাগরিক পরিবেশ থেকে এই পটভূমির পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট এবং ছিন্নপত্রের নানা পত্রে বালার গ্রামীণ জীবনের মাধুর্য ও সৌন্দর্য সুপরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। এই পল্লীজীবনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগ দুই ধারায়। তিনি খুব কাছে থেকে মানুষের পরিচয় পেয়েছিলেন। ‘সোনার তরী’ কাব্যের সূচনায় তিনি বলেছেন, “মানুষের পরিচয় খুব কাছে এসে আমার মনকে জাগিয়ে রেখেছিল। তাদের জন্য চিন্তা করেছি, কাজ করেছি, কর্তব্যের নানা সংকল্প বেঁধে তুলেছি, সেই সংকল্পের সূত্র আজও বিচ্ছিন্ন হয়নি আমার চিন্তায়। সেই মানুষের সংস্পর্শেই সাহিত্যের পথ এবং কর্মের পথ পাশাপাশি প্রসারিত হতে আরম্ভ হল আমার জীবনে।” পল্লীজীবন ও পল্লীগ্রামের মানুষের সঙ্গে নিবিড় পরিচয় রবীন্দ্রনাথের গীতিকাব্যিক অনুভবকেই প্রগাঢ় ও সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হয়, পল্লীর জনজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত হওয়া রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সম্ভব ছিল না। চলমান বোটের খোলা জানালা দিয়ে তিনি পল্লীজীবনের টুকরো ছবি দেখে গেছেন একের পর এক। তিনি নিজেই লিখেছেন, “এক সময়ে ঘুরে বেড়িয়েছি বাংলার নদীতে নদীতে, দেখেছি বাংলার পল্লীর বিচিত্র জীবনধারা। একটি মেয়ে নৌকা করে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল, তার বন্ধুরা ঘাটে নাইতে নাইতে বলাবলি করতে লাগল আহা, যে পাগলাটে মেয়ে, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ওর কি জানি কি দশা হবে। কিংবা ধর, একটা খ্যাপাটে ছেলে সারা গ্রামে দুষ্টুমির চোটে মাতিয়ে বেড়ায়, তাকে হঠাৎ একদিন চলে যেতে হল তার মামার কাছে। এইটুকু দেখেছি, বাকিটা নিয়েছি কল্পনা করে।” (সাহিত্য, গান ও ছবি: প্রবাসী ১৩৪৮ সন) এখানে ‘সমাপ্তি’ ও ‘ছুটি’ গল্পদুটির বস্তুগত পটভূমির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। দূর থেকে দেখা বস্তুজীবনের রহস্যছবিকে মানস অনুভবের রশ্মিতে আলোকিত করে পূর্ণাঙ্গ রূপ ধরেছে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের দ্বিতীয় পর্বে সবুজপত্রে প্রকাশিত গল্পগুলিতে ভাব, বিষয় ও রূপকল্পে সম্পূর্ণ নতুনত্ব লক্ষ্য করা যায়। এ হচ্ছে ১৩২১ বাংলা সনের কথা। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের আসল পালাবদলের শুরু হয়েছে ১৩০৮ সালে | রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলির মাধ্যমে সাধারণ জীবনের অদৃশ্য প্রশ্ন, চিন্তা এবং ভাবনা উজানে তুলে আনা হয়। তিনি মানুষকে আত্মবিকাশ ও মানবতার মৌলিক মূল্যবোধের দিকে উত্তরিত করতেন, এবং এটি তার ছোটগল্পে প্রতিষ্ঠিত করেন।|