রবীন্দ্র পরবর্তী সময়কালে বাংলা কাব্যসাহিত্যে জীবনানন্দ দাশ একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর কবিতার মধ্যে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ— ইতিহাস চেতনা ও সময়জ্ঞান। ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশ ইতিহাস চেতনা ও সময়জ্ঞানের পাশাপাশি বাস্তবতাবোধ ও চিত্রকল্পের অসাধারণ ব্যবহার করেছেন। এখানে স্মৃতিচারণ, হারানো সৌন্দর্য এবং হারানো পূর্ণতার মেলবন্ধন ঘটেছে। প্রেম ও সৌন্দর্যের অনুসন্ধান এই কবিতার প্রধান বিষয়। কবি লিখেছেন-
“যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি, সেই নারীর মতো ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে।”
অতীতচারিতা জীবনানন্দের কবিতায় নানাভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অতীতচারিতাকে ব্যবহার করে কবি আসলে বর্তমানকেই বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন। মূল্যবান আসবাবে ভরা অতীত প্রাসাদের যে স্মৃতি কবির মনে জেগে উঠেছে, তা শুধুমাত্র লুপ্ত স্বপ্ন নয়, তার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে কবির বর্তমানের স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের রূপটি। কবি লিখেছেন-
“কোনো এক প্রাসাদ ছিলো; মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ; পারস্য গালিচা, কাশ্মিরী শাল, বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল, আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্খা, আর তুমি নারী- ই সব ছিলো সেই জগতে একদিন।”
কবি বর্তমানে একজন অভিজ্ঞতালব্ধ মানুষ। তিনি একাকী দীর্ঘ সময় জুড়ে সুখের স্মৃতি রোমন্থন করে চলেছেন। মানুষ গৌরবময় অতীতের কাছে বারবার ফিরে যেতে চায়। তবে সে যাত্রা ক্ষণিকের। কিছুক্ষণের জন্য এক পরাবাস্তব জগতে ভ্রমণ করে আবার বর্তমানের সেই যন্ত্রণাময় জীবনেই ফিরে আসাতে হয়।
এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে কি জীবনে কোনো আশা নেই? আনন্দ নেই? কবি কিন্তু একথা মানতে চান না। কবি সৌন্দর্য সচেতন বলেই নারীকে চিরন্তনী প্রেমের মূর্তি রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাই ধূসর প্রাসাদের ছবিতেও তিনি নারীকে প্রত্যক্ষ করেছেন-
“অনেক কমলা রঙের রোদ ছিলো;
অনেক কমলা রঙের রোদ;
আর তুমি ছিলে;
তোমার মুখের রূপ কতো শত শতাব্দী আমি দেখি না, খুঁজি না।”
এখানে নারী যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা ক্লিওপেট্রা অথবা পুরাণের পাতা থেকে উঠে আসা উর্বশী বা মেনকা। কবি মগ্ন চৈতন্যের গভীরে ডুব দিয়ে অতীতের সৌন্দর্যকে অনুভব করতে চেয়েছেন, ফলে কবিতাটি হয়ে উঠেছে পরাবাস্তববাদের কবিতা। কবিতার শুরুতে ইতিহাসের যে জগৎ আমরা প্রত্যক্ষ করি সেখান থেকে কবি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসেন বাস্তবের জগতে। কিন্তু এই বাস্তবের জগতকে আমরা নগ্ন নির্জন হাতের দ্বারা ধরতে চাই। আলোর অনুসন্ধানী কবির কাছে বাস্তবতা হলো কখনো উজ্জ্বল, আবার কখনো ধূসর ম্লান। ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতায় লুপ্ত ঐশ্বর্য জগতের কেন্দ্রে রয়েছে এক নারী, যাকে পাওয়া যায় না, কিন্তু যুগে যুগে তারই আরাধনা করেন কবি। তবে শেষপর্যন্ত কবির আরাধনা যে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয় তা নয়, কবি নিজের গভীর বিশ্বাস থেকে সেই নারী মূর্তিকে অনুভব করতে পারেন। ফলে আপাতভাবে কবিতাটি পরাবাস্তবতার কবিতা হলেও জীবনের বাস্তবতাকেও নির্দেশ করেছে। এখানেইকবিতাটির সার্থকতা।