‘মানুষের মৃত্যু হলে’ কবিতাটির ভাববস্তু বিশ্লেষণ করো।   অথবা  ‘মানুষের মৃত্যু হলে’ কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।  অথবা   ‘মানুষের মৃত্যু হলে’ কবিতায় জীবনানন্দ দাশ মৃত্যু ও মৃত্যুহীন জীবনের যে পরিচয় দিয়েছেন তা বিশ্লেষণ করো।   অথবা   ‘মানুষের মৃত্যু হলে’ কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশ সময় চেতনার অভিনব ভাষ্য রচনা করেছেন- আলোচনা করো।

রবীন্দ্র পরবর্তী সময়কালে বাংলা কাব্যসাহিত্যে জীবনানন্দ দাশ একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর কবিতার মধ্যে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ- ইতিহাস চেতনা ও সময়জ্ঞান। ‘মানুষের মৃত্যু হলে’ কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশ মৃত্যু ও মৃত্যুহীন জীবনের পরিচয় যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি সময় চেতনার এক অভিনব ভাষ্য রচনা করেছেন। মৃত্যুতে মানুষের জীবনের সমাপ্তি— এই আপাত বাস্তবতা প্রকৃত জীবন সত্য নয়। জীবন চিরপ্রবহমান। জীবন-মৃত্যুর সম্পর্ককে জীবনানন্দ বিচার করেছেন জ্ঞানের আলোকে। তাইতো ‘বেলা- অবেলা-কালবেলা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘মানুদের মৃত্যু হলে’ কবিতার শুরুতেই তিনি লিখেছেন-

“মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব

থেকে যায়; অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে

প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে।”

মানবসভ্যতার উন্নয়ন একদিনে হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকে প্রত্যকটি মানুষের জ্ঞান ও কর্মপ্রচেষ্টার ফল এখানে নিহিত রয়েছে। অতীতের সেই মানুষগুলি আর নেই ঠিকই, কিন্তু তাদের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র, প্রেম, জ্ঞান, কর্মপ্রচেষ্টার প্রভাব প্রবাহিত হয়ে চলেছে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে। কবি বিশ্বাস করেন, আজকের মানুষের কণ্ঠস্বরে ধ্বনিত হচ্ছে অতীত মানবসমাজের কণ্ঠস্বর। তিনি লিখেছেন-

“তবু তারা আজকের আলোর ভিতরে সঞ্চারিত হ’য়ে উঠে আজকের মানুষের সুরে।”

মানব-ইতিহাসের ধর্ম-দর্শন-জ্ঞান-প্রেম সবকিছুই যে মানুষের ক্রমাগত কর্মপ্রচেষ্টার ফল তা দীপংকর শ্রীজ্ঞান ও বুদ্ধ-অম্বাপালীর প্রসঙ্গের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন কবি।

জীবনানন্দের কাছে সময় শুধু প্রবহমান একটি বিষয় নয়, তা হলো জীবনের উজ্জ্বলতার দিকে ক্রমাগত এগিয়ে চলা। মানুষ সবসময় প্রার্থনা করে এক শান্তিময়, সুবাতাসময়, আলোময় পৃথিবী। আর এই ধরণের পৃথিবীর বীজ তো বপন করা হয়েছিল তো সৃষ্টির আদিলগ্নেই। তাইতো অতীতকালের মানুষেরা বারবার ফিরে এসে যাচাই করে নিতে চায় পৃথিবীর কর্ম উন্নয়নের ধারাকে। কারণ তারাই তো সভ্যতার প্রথম দীপটি জ্বালিয়েছিল। তাই তাদের কাছে অন্ধকার নয়, আলোই কাম্য। কবি বলেছেন-

“সকল রৌদ্রের মতো ব্যাপ্ত আশা যদি

গোলোকধাঁধাঁয় ঘুরে আবার প্রথম স্থানে ফিরে আসে শ্রীজ্ঞান কী তবে চেয়েছিলো?”

পৃথিবীর আবর্তন গতি সত্য, কিন্তু সভ্যতার গতি হলো- ক্রম উন্নয়নের ইতিহাস। উন্নতির দিকে এগিয়ে চলাই সভ্যতার শেষ সত্য।

মৃত্যু জীবনের এক স্বাভাবিক পরিণতি। মানুষের মৃত্যু হলে দৈহিকভাবে সে আর ফিরে আসে না ঠিকই, কিন্তু তার জ্ঞান-কর্ম-চিন্তা-চেতনা বিলুপ্ত হয়ে যায় না। অতীতের অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও সে হারায় না, সেই কথা বলতে গিয়ে কবি লিখেছেন-

“শতকের আয়ু- আধো আয়ু- আজ ফুরিয়ে গেলেও এই শতব্দীকে তারা

কঠিন নিস্পৃহভাবে আলোচনা করে আশায় উজ্জ্বল রাখে; না হ’লে এ ছাড়া

কোথাও অন্য কোনো প্রীতি নেই।”

তাইতো কবি শেষপর্যন্ত উপলব্ধি করেছেন-

“মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব থেকে যায়।”

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো- ‘মানুষ’ ও ‘মানব’ দুটির শব্দের ব্যবহার। প্রথমটি ব্যবহৃত হয়েছে ব্যক্তি মানুষ অর্থে এবং দ্বিতীয়টি ব্যবহৃত হয়েছে সমষ্টিবদ্ধ মানুষ অর্থে অর্থাৎ মানবসমাজকে নির্দেশ করা হয়েছে। ব্যক্তি মানুষের কর্মপ্রচেষ্টাতেই গড়ে ওঠে মানবসমাজ, আর মানবসমাজের ক্রম উত্তরণই সভ্যতার প্রকৃত ইতিহাস। এভাবেই কবি জীবনানন্দ দাশ সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকে বর্তমান সময়ে সভ্যতার ক্রম উত্তরণের মধ্য দিয়ে মৃত্যু ও মৃত্যুহীন জীবনের পরিচয় উদঘাটন করেছেন এবং কবিতার নামকরণ ‘মানুষের মৃত্যু হলে’ সার্থক হয়েছে।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Why national building regulations. Bhogeshwari developers pen raigad. About us dm developments north west.