‘বনলতা সেন’ কবিতাটির ভাববস্তু বিশ্লেষণ করো।অথবা  ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।অথবা  ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি অবলম্বনে কবির ইতিহাস চেতনা ও প্রেমভাবনার পরিচয় দাও।

রবীন্দ্র পরবর্তী সময়কালে বাংলা কাব্যসাহিত্যে জীবনানন্দ দাশ একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি শুধু জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা নয়, সমগ্র বাংলা সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা। কবিতাটি’ বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। কবিতাটিতে জীবনানন্দের ইতিহাস চেতনা ও প্রেমভাবনা একটি ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছেন। প্রেমকে কবি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন এবং সেই প্রেমভাবনাকে প্রকাশ করতে গিয়েই তিনি ডুব দিয়েছেন ইতিহাসের জগতে।

‘বনলতা সেন’ কবিতার নায়ক ও প্রেমিক কবি স্বয়ং। প্রকৃতি আর ইতিহাসের পটভূমিকায় প্রেমের প্রকাশে ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি শাশ্বত রূপ লাভ করেছে। কবিতার প্রথম স্তবকে রয়েছে প্রকৃতি ও ইতিহাসের মধ্য দিয়ে কবির অনন্ত যাত্রা-

“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে। সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে; আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।”

জীবনানন্দের অনুভবে শাশ্বত প্রেম এখানে পরিপুষ্ট হয়েছে সুগভীর ইতিহাস চেতনায়। ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধে জীবনানন্দ বলেছেন—

“কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাস চেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।”

আলোচ্য কবিতায় কবির সেই ইতিহাস চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ‘বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগৎ’ ও ‘বিদর্ভ নগরে’– মধ্যযুগীয় ঐতিহাসিক পটভূমিকেই নির্দেশ করেছে। আর এই ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে প্রেম হয়ে উঠেছে মানসী প্রতিমা। যাকে কবি আবিষ্কার করেছেন হাজার বছর ধরে অন্বেষণের পর। হাজার বছরের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ক্লান্ত ও অবসন্ন কবিকে আশ্রয় দান করেছিল নাটোরের বনলতা সেন।

কবিতার দ্বিতীয় স্তবকে রয়েছে নায়িকা বনলতা সেনের সৌন্দর্যের বর্ণনা-

“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,

তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”

‘বিদিশা’, ‘শ্রাবস্তীর কারুকার্য’, ‘দারুচিনি-দ্বীপ’- এখানেও রয়েছে ইতিহাসের পদচারণা। আর এই ইতিহাসের উপর নির্ভর করেই ‘সবুজ ঘাসের দেশ’, ‘পাখির নীড়ের মতো’ শব্দবন্ধে একটা সুনিশ্চিত নিরাপদ আশ্রয়ের কথাই উঠে এসেছে। কবিতাটিতে প্রকৃতি, ইতিহাস ও নায়িকা বনলতা সেন এক সূত্রে বাঁধা পড়েছে। ইতিহাসের পথ ধরে এবং বনলতা সেনকে উদ্দেশ্য করে কবির অনন্ত প্রেমের অন্বেষণ এখানে এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে।

তৃতীয় স্তবকে কবি চিরন্তন প্রেমের প্রার্থনা করেছেন। সারাদিন ধরে সকলে যতই ব্যস্ত থাকুক না কেন, দিনের শেষে নিরাপদ আশ্রয় সবারই একান্ত প্রয়োজন। তাইতো দিনশেষে সকলেই ফিরে আসে ঘরে-

“সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী- ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন; থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”

সন্ধ্যার আগমনে সকলেই সারাদিনের সমস্ত লেনদেন মিটিয়ে দিয়ে শান্তির নীড়ে ফিরে আসে। কবিও তেমনি ফিরে এসেছেন বনলতা সেনের শান্তির নীড়ে।

তিনটি স্তবকে বিন্যস্ত কবিতাটির প্রথম স্তবকে রয়েছে ক্লান্ত, অবসন্ন কবির ইতিহাসের পথে দীর্ঘ যাত্রাপথের বর্ণনা। দ্বিতীয় স্তবকে ক্লান্ত কবি দারুচিনি দ্বীপের ভেতর খুঁজে পান পাখির নীড়ের মতো আশ্রয়দাত্রী বনলতা সেনকে। আর শেষ স্তবকে তিনি প্রেমের চিরন্তন রূপকে অনুভব করেন। এভাবেই প্রকৃতি, ইতিহাস চেতনা ও প্রেম ভাবনার সমন্বয়ে কবিতাটি চির স্মরণীয় হয়ে আছে। কবিতাটির মূল অবলম্বন বনলতা সেন, তাকে আশ্রয় করেই রচিত হয়েছে সম্পূর্ণ কবিতাটি। তাই কবিতার নামকরণও সার্থক হয়ে উঠেছে।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Why national building regulations. Sana wallpaper & carpet pen raigad. Photoshop, dm developments north west.