ভূমিকাঃ (Introduction)
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সর্বত্র বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। রাজনৈতিক শূন্যতা, অনিশ্চয়তা ও অরাজকতার ফলে জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে অবক্ষয়ের লক্ষণ Page সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। পুরাতন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ভাঙন দেখা দেয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় ভারত পিছিয়ে পড়ে। পলাশির যুদ্ধে ( 1757 খ্রিস্টাব্দ) জয়লাভ ও বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভের (1765 খ্রিস্টাব্দ) ফলে ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রভাব বৃদ্ধি পায়। কোম্পানির কর্মচারীরা হঠাৎ এদেশে শাসনের সুযোগ লাভ করে। ক্ষমতা দখলের পর কোম্পানির প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হল নবজাত সাম্রাজ্যটিকে রক্ষা করা। নবলব্ধ সাম্রাজ্যকে স্থায়ীভাবে রক্ষা ও সুদক্ষ ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠার জন্য কোম্পানির কর্মকর্তারা হিন্দু, মুসলমানের কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও শিক্ষাকে পূর্ব মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার কথা চিন্তা করেন, কিন্তু এদেশের মানুষের শিক্ষা বা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার জন্য কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করার পরিবর্তে তারা কেবলমাত্র এদেশের সম্পদ নির্লজ্জভাবে লুঠ করতে অগ্রসর হয়। 1811 খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল Lord Minto আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, যদি সরকার শিক্ষাখাতে অর্থ ব্যয় না করে তাহলে ভারতের শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা সম্পূর্ণ লোপ পাবে। কোম্পানির শিক্ষা সম্পর্কে উদাসিনা ইংল্যান্ডে এবং ভারতে আগত খ্রিস্টান ধর্মযাজকের দ্বারা কঠোরভাবে নিন্দিত হতে থাকে। কোম্পানির সনদ প্রতি 20 বছর অন্তর নতুন করে নেওয়ার নিয়ম ছিল। সে অনুসারে 1813 খ্রিস্টাব্দে সনদ আইন আবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে উপস্থাপন করা হয়।
সনদ আইন (Charter Act)
1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন ছিল ভারতবর্ষের শিক্ষার ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যখন ভারতবর্ষ থেকে অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তিবর্গ অপসারিত হল, ইংরেজদের প্রতিদ্বন্দ্বী আর কোনো শক্তি রইল না, ঠিক সেই সময় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষের শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হয় এবং ভারতবর্ষের শিক্ষাবিষয়ক দায়িত্ব গ্রহণ করে। এমনই এক শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কোম্পানির চার্টার অ্যাক্টের বা সনদ আইনের পুনরায় নবীকরণের জন্য পার্লামেন্টে উপস্থাপিত হল 1813 সালে।
সনদের বিষয়বস্তু আলোচনার সময় প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী দু-দলেরই মতামত গৃহীত হল। পাশ্চাত্যবাদী ও মিশনারিদের দাবি ছিল ভারতে অবাধ ধর্ম প্রচারের এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের সুবিধা আদায় করা, অপরপক্ষে কোম্পানির প্রাচ্যবাদী লোকেরা চেয়েছিলেন, ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষিত নাগরিকদের সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন ও উন্নতি বিধান, ফলে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদীদের মধ্যে তুমুল দ্বন্দ্ব শুরু হয়। অবশেষে উভয় পক্ষকে খুশি করার উদ্দেশ্যে সনদ আইনের 43নং ধারায় বলা হয়—“সাহিত্যের পুনরুজীবন
অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রবর্তন ও উন্নয়নের জন্য রাজস্ব ভাণ্ডার থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করাই হবে সপরিষদ গভর্নর জেনারেলের আইন সম্মত কাজ।” ওপরের আলোচনা থেকে 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনকে সংক্ষিপ্তভাবে তিনটি সুনির্দিষ্ট ধারার সমষ্টি বলা যায়। নিম্নে এই ধারাগুলি প্রদত্ত হল:
(1) ব্রিটিশ পার্লামেন্টের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকাল পুনরায় পরবর্তী 20 বছর অর্থাৎ 1833 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বর্ধিত হল।
(2) ভারতীয়দের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারে ও সাহিত্যের পুনুরুজ্জীবনে প্রতি বছর 1 লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হবে।
(3) ইংরেজি শিক্ষাবিস্তার ও ধর্মপ্রচারের অনুমতি দেওয়া হল খ্রিস্টান মিশনারিদের 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন অনুসারে।
সনদ আইনের গুরুত্ব (Importance of Charter Act)
1813 খ্রিস্টাব্দে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সনদ ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করে। এই সনদ আইন প্রবর্তিত হওয়ার ফলে ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযোজিত হয় এবং ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার একটি সুনির্দিষ্ট রূপ দেখা দিতে শুরু করল। ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনের প্রস্তাব আজও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন-
(i) 1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে গ্রান্টের প্রস্তাব আংশিকভাবে মেনে নেওয়ার ফলে মিশনারিদের ধর্মপ্রচার ও শিক্ষাবিস্তার ব্যাপারে অনেকটা স্বাধীনতাও দেওয়া হল। ফলে মিশনারিরা নবোদ্যমে পুস্তক প্রকাশ, নারীশিক্ষা বিস্তারে, অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কাজ শুরু করলেন, মিশনারিরা বহু শিক্ষিত লোকের সমর্থন ও সহযোগিতা পেতে লাগলেন। মিশনারিদের প্রতি কোম্পানির মনোভাব প্রীতিপূর্ণ হয়ে উঠল এবং মিশনারিরা বিদ্যালয় ও কলেজ প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগ দিলেন। এ সময় থেকেই কোম্পানির অধিকৃত রাজ্যগুলিতে খ্রিস্টান মিশনারিরা অধিকতর উদ্যমে ধর্মপ্রচার ও পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারে অগ্রসর হয়েছিলেন।
(ii) সনদ আইনের শিক্ষাধারাকে ভারতে সরকারিভাবে শিক্ষা বিস্তারের প্রথম পদক্ষেপ বলা যেতে পারে। এখানেই ভারতীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম সরকারি অর্থ মঞ্জুর করা হয়।
(iii) সনদ আইনের 43নং ধারায় ভারতের জনশিক্ষার জন্য এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। এই বরাদ্দ অর্থ ব্যয় করা সম্পর্কে সনদ আইনে এমন দ্ব্যর্থব্যঞ্জক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছিল যে, তা প্রচুর বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল এবং পরবর্তী অর্ধ শতাব্দী ধরে তা নিয়ে প্রবল বিতর্কের ঝড় বয়েছিল। শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য, শিক্ষার ভাষা, মাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাবিস্তারের পদ্ধতি ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রচুর বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল এবং বিভিন্ন দলের মধ্যে তিক্ত দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছিল।