মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন/মুদালিয়র কমিশন ( 1952 -1953) (Secondary Education Commission / Mudaliar Commission 1952-1953)

স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা কোন্ পথে পরিচালিত হবে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তার দিক নির্ধারণ করেছিল রাধাকৃয়ন কমিশন। কিন্তু দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যালয় শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রসারের কথা বিবেচনা করে 1952 1953 খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. লক্ষণস্বামী মুদালিয়রের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে যেটি মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন বা মুদালিয়র কমিশন নামে খ্যাত।

মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (Alms and objectives of Secondary Education)

মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন প্রথমেই মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলে (i) জাতীয় সম্পদ সৃষ্টি: দারিদ্র্যপীড়িত এই বিশাল দেশের সমৃদ্ধির জন্য জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি ও জীবনের মানোন্নয়নের গুরুদায়িত্ব শিক্ষার্থীদের গ্রহণ করতে হবে।

(ii) সুযোগ্য নাগরিক সৃষ্টি। মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হল সুযোগ্য নাগরিক তৈরি করা। শিক্ষার্থীকে জীবন সংগ্রামের প্রকৃতির শিক্ষা এই স্তরে দিতে হবে। জাতীয় সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের জন্য প্রস্তুত করে তোলাই শিক্ষার দেশের জন্য উপযুক্ত নাগরিক গড়ে তোলাই জাতীয় শিক্ষার লক্ষ্য।

(iii) বৃত্তিশিক্ষার যোগ্যতা অর্জন ও বিকাশ মাধ্যমিক শিক্ষার শেষে শিক্ষার্থী যাতে বাস্তব জীবনের দায়িত্ব গ্রহণে সক্ষম হয় বা বৃত্তি শিক্ষার যোগ্যতা অর্জন করে তার দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে।

(iv) আদর্শ চরিত্রগঠন: মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হল আদর্শ চরিত্রগঠন। একটি সমাজের ক্ষেত্রে আদর্শ চরিত্র গড়ে তোলা অপরিহার্য। সুতরাং জাতির বিকাশের জন্য শিক্ষার্থীর চরিত্র গণতান্ত্রিক আদর্শে গড়ে তুলতে হবে: “The training of character to fit the students to participate creatively as citizens in the emerging democratic social order”

 (i) মানবিক গুণাবলির বিকাশঃ মুদালিয়র কমিশনের মতে শিক্ষার্থীর মধ্যে শৃঙ্খলা, বিনয়, ভালোবাসা, সহযোগী মনোভাব প্রভৃতি মানবিক গুণগুলির বিকাশ সাধন করার ক্ষেত্রে পাঠ্যক্রমে এমন কিছু বিষয় রাখতে হবে, যা শিক্ষার্থীর মধ্যে মানবিক গুণগুলির বিকাশ ঘটাবে। সেজন্য সাহিত্য, বিজ্ঞান, চারুকলা, নৃত্যগীত প্রভৃতি বিষয়ের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে।

 (vi) গণসংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন: জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য গণসংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশনের মতে দেশের শিক্ষার্থীদের মানুষের মহত্বে বিশ্বাস রাখতে হবে। দেশের সভ্যতা-সংস্কৃতির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে। তার সঙ্গে নবসংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

(vi) সুযোগ্য নেতৃত্ব গঠন করা: সুযোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলা শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য। কোনো দেশের সামগ্রিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন সুযোগ্য নেতার। আর সেই সুযোগ্য নেতৃত্ব গঠনের মানসিকতা তৈরি করতে পারে শিক্ষা। বৃত্তিমূলক যোগ্যতার উন্নয়ন, ব্যক্তিত্বের বিকাশ, আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের নেতৃত্ব দানের যোগ্যতার বিকাশ হবে মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য। (vii) বয়ঃসন্ধিকালের চাহিদা মেটানো: মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য শুধুমাত্র সামাজিকও অর্থনৈতিক চাহিদার ওপর নির্ভরশীল নয়। বয়ঃসন্ধিকালের বিকাশের ধারা ও চাহিদার কথা মাথায় রেখে মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণে নিম্নলিখিত বিষয়বস্তুগুলির দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

  • বয়ঃসন্ধিক্ষণে শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে পূর্ণতা আসতে থাকে। এই সময়ের কিশোর-কিশোরীরা সর্বদা কর্মমুখর হয়। সুতরাং, মাধ্যমিক শিক্ষা যাতে সক্রিয়তার চাহিদা মেটাতে পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

(b) বয়ঃসন্ধিকালে শিক্ষার্থীদের সামাজিক চেতনার বিকাশ ঘটতে থাকে। এই বিকাশকে তরান্বিত করার জন্য বিদ্যালয়ের কর্তব্য হল শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহযোগিতামূলক যৌথ কর্মের সুযোগ সৃষ্টি করা। এ ছাড়া তাদেরকে সামাজিক আচার-আচরণ ও অনুশাসনে অভ্যস্ত করে তোলা।

(c) বয়ঃসন্ধিকালে শিক্ষার্থীরা নানা আবেগেও প্রক্ষোভের সম্মুখীন হয়। তাই এই সময় বৃত্তিমূলক শিক্ষার আয়োজন করা বাঞ্ছনীয়।

(d) এই সময় শিক্ষার্থীর মনে যৌন কৌতূহল প্রকাশ পেতে থাকে। তাই এই সময় তাদের সৃষ্টিমূলক, সাংস্কৃতিক কর্মানুসন্ধানে উৎসাহিত করতে হবে।

(e) মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব সৃষ্টি করা। এই মনোভাব সৃষ্টির পথে যা-কিছু বাধা আছে তা যেন শিক্ষার্থীরা অতিক্রম করতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখাই হবে শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য।

(f) এই স্তরে এমন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা সমস্যা সমাধানের জন্য বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে।

 

 

মাধ্যমিক শিক্ষার কাঠামো (Structure of Secondary Education):

মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন বা মুদালিয়র কমিশন সামগ্রিক শিক্ষা পরিকল্পনার কথা চিন্তা করে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার জন্য নিম্নলিখিত কাঠামো সুপারিশ করে—

(i) প্রাথমিক নিম্ন বুনিয়াদি শিক্ষা—চার অথবা পাঁচ বছর। (ii) মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে থাকবে দুটি ভাগ।

(a) তিন বছরের নিম্নমাধ্যমিক শিক্ষাস্তর। (b) চার বছরের উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাস্তর।

(iii) মুদালিয়র কমিশনের মতে, তৎকালীন দু-বছরের ইনটারমিডিয়েট স্তরকে তুলে দিয়ে এই স্তরের এক বছর মাধ্যমিক স্তরের সঙ্গে যুক্ত করে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পরিণত করতে হবে। আবার ইনটারমিডিয়েট স্তরের বাকি এক বছর ডিগ্রি স্তরে যুক্ত করে তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স চালু করতে হবে। তবে যতদিন পর্যন্ত উপরোক্ত ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হচ্ছে না ততদিন উভয় ব্যবস্থাই পাশাপাশি চলতে থাকবে।

(iv) পৃথকভাবে বহুমুখী বিদ্যালয়গুলির সঙ্গে কারিগরি বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। কারিগরি বিদ্যালয় শিল্পসমৃদ্ধ এলাকায় স্থাপন করা প্রয়োজন। এই বিদ্যালয়গুলিতে বিভিন্ন শিল্পের সহযোগিতা গ্রহণ করতে হবে।

(v) মাধ্যমিক স্তরে কারিগরি শিক্ষার কোর্স নির্ধারণ, পাঠ্যসূচি সংগঠন ইত্যাদির ক্ষেত্রে All India Council for Technical Education (AICTE)-র মতো সংস্থাগুলির সহযোগিতা নেওয়া দরকার

Education Cess) বসাতে হবে। কমিশন বলেন, যারা প্রাক বিশ্ববিদ্যালয় কোর্স বা উচ্চতর মাধ্যমিক কোর্স শেষ করবে তারাই পেশাগত শিক্ষার কলেজে ভরতি হতে পারবে। আবার বৃত্তিমূলক শিক্ষার কলেজগুলিতেও এক বছরের প্রাক্ বৃত্তিমূলক কোর্স চালু করতে হবে।

(vi) প্রতিটি রাজ্যেই গ্রামাঞ্চলে কৃষি বিদ্যালয় সথাপন করতে হবে। এই ধরনের কৃষি বিদ্যালয়গুলিতে উদ্যান নির্মাণ, পশুপালন ও কুটির শিল্প ইত্যাদি শিক্ষারও ব্যবস্থা। করা দরকার। কিছু গ্রামীণ কলেজে ওই সমস্ত বিষয়ে শিক্ষার সুযোগের ব্যবস্থা করা দরকার।

(vii) যে-সমস্ত অঞ্চলে শিক্ষার সুযোগ রয়েছে সেখানে বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। এই বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের রুচি, প্রবণতা অনুযায়ী পড়ার সুযোগ পাবে।

29 (vii) শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার জন্য উপযুক্ত সংখ্যক বিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।

(ix) মেয়েদের জন্য পৃথক বিদ্যালয় ও উপযুক্ত পাঠ্যবিষয় পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। মেয়েদের শিক্ষার জন্য গার্হস্থ্য শিক্ষা, শিল্পকলা, সংগীত ইত্যাদি বিষয়গুলি পাঠক্রমে আনতে হবে।

 (x) যেসব ব্যক্তি Transferable চাকুরি করেন তাঁদের জন্য গ্রামাঞ্চলে আবাসিক বিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে। (xi) ছেলেমেয়েরা যাতে সমশিক্ষা লাভ করতে পারে ও সমসুযোগ পায় সেই কারণে

সহশিক্ষার স্কুলের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

(xii) 14 বছর পর্যন্ত সম্পূর্ণ সময়ের শিক্ষা গ্রহণ করার আগে যাদের পড়া বন্ধ হয়ে যাবে তাদের আংশিক সময়ের শিক্ষার জন্য বিশেষ বিদ্যালয় স্থাপন করা প্রয়োজন। এই শিক্ষা হবে অবৈতনিক এবং স্থানীয় বিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত।

(xiii) কমিশন মনে করে, বাস্তবের সঙ্গে সংগতি রেখে পাবলিক স্কুল স্থাপন করা দরকার। এই স্কুলগুলিকে জাতীয় ভাবধারায় অনুপ্রাণিত করতে হবে। এই বিদ্যালয়গুলির শিক্ষাপদ্ধতি ও ব্যবস্থা প্রচলিত বিদ্যালয়গুলি থেকে পৃথক হবে।

(xiv) মুদালিয়র কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী মাধ্যমিক শিক্ষার স্থায়িত্বকাল হবে 7 বছর। 11-17 বছরের শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষা লাভ করবে। এই সুপারিশে শিক্ষা- ব্যবস্থা কাঠামো সম্পর্কে যে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলি করা হল তা পরবর্তীকালে বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকার আংশিক বা পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করেছিল। 1964- 1966 খ্রিস্টাব্দের সুপারিশের আগে পর্যন্ত এই সুপারিশটি ছিল আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Concrete in cold weather a quick guide. My invoices explore your city. Tf header footer template dm developments north west.