চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল :-
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রাজস্ব আদায় :
বছরের নির্দিষ্ট সময়ে পূর্বনির্ধারিত রাজস্ব আদায় করার লক্ষ্যে কোম্পানি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন ঘটায় । জমিদাররা সূর্যাস্ত আইনের হাত থেকে জমিদারি রক্ষার লক্ষ্যে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব জমা দিতে বাধ্য থাকেন । এর ফলে কোম্পানি নির্দিষ্ট সময় তার নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব আদায় সম্পর্কে নিশ্চিত থাকত ।
অনুগত জমিদার সম্প্রদায় সৃষ্টি :
কোম্পানি চেয়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবাদে জমির নির্দিষ্ট মেয়াদ প্রদান করে একশ্রেণির জমিদার তৈরি করতে , যারা কোম্পানির প্রতি আনুগত্যশীল থাকবে । এরা বাংলায় কােম্পানির শাসনের সহযােগী হিসেবে কোম্পানি বিরােধী গণ অসন্তোষগুলির সমাধানে সাহায্য করবে বলে আশা প্রকাশ করে কোম্পানি । এ প্রসঙ্গে কর্নওয়ালিশ নিজেই বলেছিলেন — সমাজে শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য এক মর্যাদাবান ও প্রভাবশালী শ্রেণির সাহায্য দরকার ।
স্থায়ী ভূমিরাজস্বের হার নির্ধারণ :
কোম্পানি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে ভূমি রাজস্বের হার নির্ধারণ করতে চেয়েছিল । এক্ষেত্রে কোম্পানির লক্ষ্য ছিল চিরতরে ভূমিরাজস্বের হার নির্ধারণ করে দিতে পারলে বছরের শেষে আদায়িকৃত রাজস্বের পরিমাণ সম্পর্কে দুশ্চিন্তা দূর হবে । আর্থিক স্থিরতা আসলে ব্রিটিশ সুষ্ঠুভাবে নিশ্চিন্তে প্রশাসন পরিচালনা করতে পারবে ।
বাজেট তৈরি :
ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল একবার ভূমিরাজস্বের হার স্থায়ীভাবে নির্ধারিত করে দিতে পারলে একদিকে যেমন বার্ষিক আয়ের পরিমাণ জানা যাবে , অপরদিকে ব্যয়ের পরিকল্পনা গ্রহণও সম্ভব হবে এককথায় বার্ষিক আয়ব্যয়ের হিসেব বা বাজেট তৈরি করতে সুবিধা হবে ।
নিলাম ব্যবস্থা থেকে মুক্তি :
রাজস্ব ব্যবস্থার বিভিন্ন পর্বে মধ্যস্বত্বভােগীদের নিয়ােগ করে কোম্পানি অনেক সময় রাজস্ব সংগ্রহ করত । অনেক ক্ষেত্রে নিলাম ডাকের সময় যে অর্থমূল্য উঠত তার সম্পূর্ণ অংশ কোম্পানির ঘরে রাজস্ব হিসেবে জমা হত না । এ ছাড়াও আদায় করা রাজস্বের পরিমাণ বছর বছর আলাদা হওয়ায় বা বছর বছর নিলামদার পালটে যাওয়ায় জমিদার বা রায়ত কেউই চাষের উন্নতির দিকে নজর দিত না । আবার এই ব্যবস্থায় প্রতিবছর নতুন খাজনার হার নির্ধারিত হত । নিলাম ব্যবস্থার এই ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন ।
বাংলার সমাজ এবং অর্থনীতিতে এর প্রভাবগুলি :
১. রায়তদের অধিকার অরক্ষিত
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে সরকার জমিদার, জমিদার সরকার সম্পর্কের কথা বলা থাকলেও রায়ত ও জমিদার বা রায়তের সাথে বিরূপ সম্পর্ক হবে তার বিবরণ ছিল না। অর্থাৎ, এ ব্যবস্থায় রায়তের অধিকার সুরক্ষিত হয় নি। জমিদাররা শুধু এ ব্যবস্থার স্থায়ী মালিকানা লাভ করেছিল। তারা রায়তকে ইচ্ছা করলে জমি থেকে উৎখাত করতে পারেন, যদি রায়ত তার পাওনা জমিদারকে সময়মত না দেয়। অবশ্য এ বন্দোবস্তে দশ বছরের জন্য পাট্টায় লিপিবদ্ধ করে রায়তের অধিকার দেয়ার কথা থাকলেও তা করা হয় নি।
২. রায়তের উপর অত্যাচার
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বলা হয়েছিল যে, জমিদার খাজনা অনাদায়ের জন্য রায়তকে দৈহিক নির্যাতন করতে পারবে না। অথবা রায়তের সম্পত্তি, লাঙল, গরু প্রভৃতি দখল বা ক্রোক করতে পারবেন না। তবে জমিদার দেওয়ানি মামলায় রায়তকে অভিযুক্ত করতে পারবেন। এভাবে জমিদার ও রায়তের পূর্বের সম্পর্কের ইতি ঘটিয়ে কেবল অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা হয় । তাছাড়া খাজনা বকেয়া পড়লে নতুন জমিদার কর্তৃক রায়তের উপর দৈহিক নির্যাতন ও রায়তের সম্পত্তি ক্রোক করা কোন কিছুই তারা বাদ দেন নি।
৩. অতিরিক্ত অর্থের দাবি
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারকে জমির মালিকানা দিলেও এতে বলেন যে, জমিদাররা খাজনার অতিরিক্ত কোন অর্থ রায়তের কাজ থেকে দাবি করতে পারবে না। কিন্তু দেখা যায় কার্যকরী হয় এর উল্টোটা। রায়তকে প্রায়ই নানা কারণে অর্থ দিতে হত, যে অর্থ রায়তের রাজস্ব হিসাবের বাইরের। তাই একদিকে উচ্চহার, উপরন্তু অতিরিক্ত অর্থ আদায় করার ফলে রায়তের আর্থিক কষ্টের সীমা ছিল না।
৪. রায়তের হস্তে সম্পদের মাত্র ৪০ ভাগ
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে বলা যায় যে, যদিও সরকারি পক্ষ থেকে বলা হয় যে এটা সুদীর্ঘ দু’দশকের পর্যালোচনার ফসল কিন্তু তারা কোন নথিপত্র বা পরিসংখ্যানের ধার ধারেন নি। যে কারণে দেখা যায় রাজস্ব নির্ধারিত হয় অতি উচ্চহারে সরকারের খেয়াল খুশিমত। এ ব্যাপারে জমিদারদের মতামত নেয়ার প্রয়োজন সরকার মনে করতেন না। বলাবাহুল্য সরকার খুবই উচ্চহারে খাজনা ধার্য করেছিল এবং আদায় করেছিল। এ ধরনের অবস্থায় দেখা যায় বাংলার মোট উৎপাদনের শতকরা মাত্র ৪০ ভাগ ছিল রায়তের এবং বাকি ৬০ ভাগের মধ্যে সরকারের ৪৫ ভাগ এবং জমিদার বা মধ্যস্বত্বভোগীর ১৫ ভাগ।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেন তা ছিল কোম্পানির একটি রাজস্ব আদায়ের কৌশল মাত্র। এ কৌশল প্রয়োগ করে কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের নিশ্চয়তা পান। কিন্তু অন্যদিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে এ ব্যবস্থায় আদৌ তেমন সুফল বয়ে আনে নি। এ ব্যবস্থার ফলে সুদীর্ঘকাল থেকে জমিদার ও রায়তের মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল তা বিনষ্ট হয়। জমিদার শুধু খাজনা আদায় করবেন এটাই ছিল তাদের নীতি। তাই বলা যায়, কোম্পানির স্বার্থগত দিক থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভাল হলেও বাংলার মানুষের কাছে এটা ছিল শোষণের হাতিয়ারস্বরূপ।
সমালোচকদের মত
সমালােচকদের মতে , লর্ড কর্নওয়ালিশ বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রয়ােগ ঘটিয়ে এদেশের শিল্প বাণিজ্যকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন । কিন্তু এ বক্তব্যের বিরােধিতা করে ড . বিনয় চৌধুরী বলেছেন , বাংলার শিল্প বাণিজ্য ধ্বংসের কোনাে ইচ্ছা লর্ড কর্নওয়ালিশের ছিল না । বরং তিনি মনে করতেন যে শিল্প বাণিজ্যের উন্নতির স্বার্থে কৃষির অগ্রগতি দরকার এবং জমিদাররা স্থায়ী স্বত্ব পেলে কৃষিব্যবস্থার উন্নতি হবে । তবে অধ্যাপক পি . জে . মার্শালের মতে — শুধুমাত্র প্রশাসনিক প্রয়ােজনই না , রাজনৈতিক স্বার্থেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রয়ােজন হয়