ভূমিকা :-ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের অগ্রদূত ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ২২ শে মে হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে এক রক্ষণশীল ধনী ব্রাহ্মণ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ফ্রান্সিস বেকন, ভলতেয়ার, টম্পেইন প্রমূখ পাশ্চাত্য মনীষীর আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত রাজা রামমোহন রায়ের জীবনের ব্রত ছিল ভারতবাসীর ক্ষয়ীষ্ণু ধর্মীয় চিন্তা ও পতনমুখ সমাজ ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করে তাকে নতুন প্রাণ শক্তি দান করা এবং পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান দ্বারা জাতিকে সমৃদ্ধশালী করে তোলা। এই কারণে তাকে আধুনিক ভারতের জনক, ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ ও আধুনিক ভারতের ইরাসমাস প্রভৃতি অভিধায় ভূষিত করা হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাকে ভারত পথিক নামে সম্বোধন করেছেন।
A.ধর্ম সংস্কার :-কিশোর বয়স থেকেই রামমোহন রায় ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও কর্ম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে তিনি সেগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে ধর্ম সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি তার অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা জাতিভেদ প্রথা ও পৌত্তলিকতায় আচ্ছন্ন হিন্দু সমাজের অবক্ষয়ের চিত্রটি স্পষ্ট দেখতে পান এবং তা রোধে সচেষ্ট হন।
১.বেদান্তের আদর্শ :-রামমোহন রায়ের ধর্ম সাধনার মূল ভিত্তি ছিল বেদান্ত। বেদান্তের আদর্শ দ্বারা তিনি একদিকে যেমন ঔপনিষেদিক হিন্দু ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন, অন্যদিকে তেমনি খ্রিষ্টান মিশনারিদের আক্রমণের হাত থেকে হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করেন।
২.একেশ্বরবাদ প্রচার:-রাজা রামমোহন রায় যুক্তিবাদের আলোকে একেশ্বরবাদ প্রচার করেন। তিনি বলেন বেদ ও উপনিষদে পৌত্তলিকতা, পুরোহিত তন্ত্র ও বহু দেবতা পূজার উল্লেখ নেই। ব্রাহ্মণ ও পুরোহিত রাই এই কুপ্রথা গুলির জন্য দায়ী। তিনি বলেন একেশ্বরবাদই সকল ধর্মের মূল কথা এবং হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রে উল্লিখিত নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। তাই তিনি তার এই একেশ্বরবাদের সমর্থনে ‘তুহাফৎ-উল-মুয়াহিদ্দিন’ বা ‘একেশ্বরবাদীদের প্রতি’ নামে এক পুস্তিকা প্রকাশ করেন। বেদ, উপনিষদ প্রভৃতি গ্রন্থ ব্যাখ্যার দ্বারা এবং বেদান্ত ও উপনিষদের বাংলা অনুবাদ প্রকাশকরণের দ্বারা তিনি তাঁর মতবাদ প্রচার ব্রতী হন।
৩.আত্মীয় সভার প্রতিষ্ঠা :-কলকাতার উদারপন্থী শিক্ষিত ব্যক্তিদের স্বাধীনভাবে ধর্মালোচনার সুযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায় তাঁর বন্ধু ও অনুগামীদের নিয়ে আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করেন। হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতা, জাতিভেদ প্রথা, সতীদাহ প্রথা প্রভৃতি ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এই সভা সোচ্চার হয়েছিল। দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, নন্দকিশোর বসু প্রমূখ ছিলেন এই সভার উল্লেখযোগ্য সদস্য।
৪.ব্রাহ্ম সভা প্রতিষ্ঠা:-একেশ্বরবাদী আদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায় ব্রাহ্ম সভা প্রতিষ্ঠা করেন, যা ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিতি লাভ করে। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান আদর্শ ছিল নিরাকার পরম ব্রহ্মের উপাসনা। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একেশ্বরবাদী আদর্শ প্রচারের দ্বারা তিনি খ্রিস্টান মিশনারীদের হাত থেকে হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করেছিলেন।
B.সমাজ সংস্কার:-উপনিবেশিক শাসনকালে ভারতীয় সমাজের অধগতি রোধ করার উদ্দেশ্যে রামমোহন রায় সমাজ সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কারণ তিনি উপলব্ধি করেন যে সামাজিক কুসংস্কার ও দুর্নীতি গুলি দূর করা না গেলে জাতি গঠন সম্ভব নয়। তাই রক্ষণশীলদের সবরকম ভীতিপ্রদর্শন ও নিন্দা উপেক্ষা করে তিনি সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে বেশ কিছু সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
. ১.জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা :-রামমোহন রায় ছিলেন জাতিভেদ প্রথার তীব্র বিরোধী। জাতিভেদ প্রথার অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে তিনি ব্রজসূচী গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ করেন এবং জাতিভেদ প্রথার বিষময় ফল সমাজের পক্ষে কতটা ক্ষতিকর সে বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে উদ্যোগী হন। আসলে তার স্বপ্ন ছিল জাতপাত ও ভেদাভেদহীন একটি সমাজ গড়ে তোলা।
২.নারী জাতির উন্নয়ন :- রামমোহন রায় মনে করতেন পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের প্রাপ্য অধিকার ফিরিয়ে না দিলে সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতির পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। তাই তিনি নারী-পুরুষ সমান অধিকার, স্ত্রী শিক্ষার বিস্তার, বাল্যবিবাহ রোধ ও বহু বিবাহ রোধ করার বিষয়ে উদ্যোগী হন। হিন্দু নারীর দায়াধিকার সম্পর্কে তিনিই প্রথম মত প্রকাশ করেন। তাঁর চেষ্টায় সরকার স্বামী ও পিতার সম্পত্তিতে স্ত্রী ও কন্যার অধিকারকে স্বীকৃতি দেন।
৩.সতীদাহ প্রথা রোধ :-তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত সর্বাপেক্ষা অমানবিক প্রথা ছিল সতীদাহ প্রথা। এই প্রথা অনুযায়ী স্বামীর মৃত্যু হলে তার জ্বলন্ত চিতায় স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা হত। রামমোহন রায় এই ঘৃণ্য ও নিষ্ঠুর প্রথার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন এবং আন্দোলন শুরু করেন। বিভিন্ন হিন্দু ধর্ম শাস্ত্র পাঠ করে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে সতীদাহ প্রথা ধর্মবিরুদ্ধ ও অশাস্ত্রীয়। তাই এই কুপ্রথা নিবারণের উদ্দেশ্যে তিনি বাংলার বিশিষ্ট নাগরিকদের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদনপত্র বড়লাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এর কাছে জমা দেন। শেষ পর্যন্ত রামমোহন রায়ের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতায় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ৪ ঠা ডিসেম্বর সপ্তদশ বিধি নামে এক আইন পাশ করে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন।
C.শিক্ষা সংস্কার :-কেবলমাত্র ধর্মীয় বা সামাজিক সংস্কারের ক্ষেত্রেই নয় শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রেও রামমোহন রায়ের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ভারতবাসীদের জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে নবভারত গড়ে উঠবে। স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১.শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন :-পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে রামমোহন রায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বিষয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নিজ ব্যয়ে কলকাতায় একটি অ্যাংলো হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন বেদান্ত কলেজ। শুধু তাই নয়, ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজ এবং ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠার সঙ্গেও তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটির সক্রিয় সদস্য।
২.পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থক :-পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে রামমোহন রায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ইংরেজ সরকার ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে রামমোহন রায়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বড়লাট লর্ড আমহার্স্ট কে একটি চিঠি লেখেন এবং ভারতবাসীর জন্য পাশ্চাত্য গণিত, প্রকৃতি বিজ্ঞান, রসায়ন, পাশ্চাত্য দর্শন, ইংরেজি ভাষা শিক্ষা প্রভৃতির দাবি জানান।
৩.বাংলা ভাষার বিকাশ :-বাংলা ভাষার বিকাশে রামমোহন রায়ের অবদান কম ছিলনা। তিনি প্রথম বাংলা ভাষায় ব্যাকরণ গ্রন্থ গৌড়ীয় ব্যাকরণ এবং বেদান্ত গ্রন্থ রচনা করেন। প্রকৃত অর্থে কোন সাহিত্যধর্মী গ্রন্থ রচনা না করলেও একেশ্বরবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি ব্রজসূচী ও উপনিষদ এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। তিনি সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় সংস্কৃত ব্যবহারের বিরোধিতা করেন এবং বাংলা ভাষায় গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ রচনা রীতি প্রবর্তন করেন।
D.অন্যান্য সংস্কার :-শুধুমাত্র ধর্ম ও সমাজ সংস্কারই রামমোহন রায় সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করতে উদ্যোগী হলে তিনি তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং আন্দোলন গড়ে তোলেন। হিন্দু ধর্মের সংস্কার সাধন ও একেশ্বরবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে তিনি বেশকিছু পুস্তিকা রচনা করেন এবং সম্বাদ কৌমুদী ও মিরাৎ-উল-আকবর নামক সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এছাড়া কৃষকদের ওপর জমিদারদের অত্যাচার, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার, দেশীয় পণ্যের উপর অধিক শুল্ক আরোপ, বিচার বিভাগের দুর্নীতি, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল, ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজ কর্মচারীদের উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ প্রভৃতির বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি সরকারের উচ্চ পদ গুলি ও সামরিক বিভাগের ভারতীয়করণ, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, জুরি প্রথার প্রবর্তন এবং বিচারের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ও ভারতীয় নির্বিশেষে সকলের জন্য একই আইন প্রয়োগের দাবি জানান।
E.মূল্যায়ন:-রাজা রামমোহন রায়ের কৃতিত্বের মূল্যায়ন নিয়ে পন্ডিত মহলে নানা মত-পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে ভারত পথিক; দিলীপ কুমার বিশ্বাস তাকে বিশ্বপথিক; পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু তাকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক; ও ডঃ পার্সিভ্যাল স্পিয়ার তাকে আধুনিক ভারতের স্রষ্টা বলে অভিহিত করলেও ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার ও ডেভিড কফ ধর্ণ, সমাজ শিক্ষা ও আধুনিকতার অগ্রদূত হিসেবে রামমোহন রায়ের সকল কৃতিত্বকে অস্বীকার করেছেন। রামমোহন রায়ের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ তিনি হিন্দু ধর্মের কুসংস্কার, পৌত্তলিকতা, সতীদাহ প্রথা প্রভৃতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলেও জাতিভেদ প্রথা ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে সেভাবে রুখে দাঁড়াননি। তিনি কখনোই ব্রাহ্মণের উপবীত ত্যাগ করেননি এবং বিদেশে যাত্রাকালের সঙ্গে ব্রাহ্মণ পাচক নিতে ভোলেননি। শুধু তাই নয়, পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের পক্ষে বলতে গিয়ে তিনি দেশীয় শিক্ষার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন। ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি দেশীয় শিক্ষা ও মাতৃভাষা প্রসারেরও যে প্রয়োজন আছে তা তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি, এরূপ সমালোচনার সত্বেও নিঃসন্দেহে তাকে ভারতের নবজাগরণের অগ্রদূত বলে স্বীকার করা উচিত। কারণ তিনি ছিলেন সমাজ সংস্কারক, বিপ্লবী নন। ডঃ বিপানচন্দ্র এর মতে-“Rammohan Roy was the brightest star in the Indian sky during the first half of the 19th century”.