১৬০০ খ্রিস্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটেনের এলিজাবেথ (১৫৫৮-১৬০৩ খ্রি.) ভারত ও পূর্ব-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে বাণিজ্য করার জন্য ব্রিটেনের পক্ষে একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার দিয়ে ২১৭ জন বণিককে একটি প্রাইভেট জয়েন্ট স্টক কোম্পানি গঠন করার জন্য চার্টার প্রদান করেন। কোম্পানির নাম “The Governor and Company of Merchants of London Trading into the East Indies.’ যৌথ পুঁজি ছিল মোট আটষট্টি হাজার পাউন্ড। মেয়াদ পনেরো বছর, কিন্তু নবায়নযোগ্য । প্রায় দেড়শত বছর পর্যন্ত অবাধ বাণিজ্য সম্পর্কের পর কোম্পানি এদেশে স্থাপন করলো একটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া প্রথম থেকেই শুরু হয়নি। সতেরো শতকের শেষ সিকি অব্দি কোম্পানির বাণিজ্যিক আনাগোনায় রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল অনুপস্থিত। প্রথমদিকে কোম্পানির প্রত্যক্ষ লক্ষ্য ছিল দূর প্রাচ্যে মসলা ব্যবসায়। সেখানে ব্যর্থ হয়েই কোম্পানি ভারত-বাণিজ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করে।
কোম্পানির প্রথম বাণিজ্যকুঠি স্থাপিত হয় ভারতের পশ্চিম উপকূল-বন্দর সুরাতে (১৬১৩ খ্রি.)। এর বিশ বছর পর অর্থাৎ ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সঙ্গে নামে মাত্র বাণিজ্য উদ্বোধন করা হয়। বঙ্গদেশের সঙ্গে কোম্পানির বাণিজ্য যোগাযোগ স্থাপনের প্রথম বিশ বছর অতিবাহিত হয় অনিশ্চিত দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে। এমনকি কোম্পনির বাংলা-বাণিজ্য লাভজনক নয় বিধায় কয়েকবার এ অঞ্চলে বাণিজ্য যোগাযোগ বন্ধ করে দেবারও প্রস্তাব করা হয়। ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বাংলায় একটি বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করার জন্য। হুগলীতে স্থাপিত হলো প্রথম সে বাণিজ্যকুঠি (১৬৫১)। এরপর থেকে বাংলায় বাণিজ্যিক বিনিয়োগ ক্রমাগত বৃদ্ধির মাধ্যমে কালে এ অঞ্চলে কোম্পানি ইউরোপীয়দের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে আবির্ভূত হয়, যেজন্য হুগলীতে কুঠি স্থাপনের ঘটনাকে বলা হয় “বাংলায় ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার পথে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ মাইল ফলক”। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো ১৬৮৬-৯০ খ্রিস্টাব্দের এ্যাংলো-মুঘল যুদ্ধের পর বাৎসরিক থোক তিন হাজার টাকা শুল্ক প্রদানের শর্তে বাংলায় অবাধ বাণিজ্য করা সহ জব চার্নককে সুতানুটিতে বসতি স্থাপনের অনুমতি প্রদান করা; ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানিকে কলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর নামক তিনটি গ্রামের উপর সর্বক্ষমতা অর্পণ করে জমিদারি সনদ প্রদান করা এবং কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ স্থাপনের অনুমতি প্রদান করা। সম্রাট শাহরীয়রের ফরমান (১৭১৭), অস্ট্রীয় উত্তরাধিকার যুদ্ধের (১৭৪০-৫৬) প্রতিক্রিয়া, সিরাজউদ্দৌলা কর্তৃক কাশিমবাজার ও কলকাতা দখল এবং সবশেষে সিরাজবিরোধী চক্রান্ত তৈরি করে পলাশী যুদ্ধের আশু পরিবেশ।
৩৫৬ বাংলায় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যকলাপ ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত, পলাশীর সঙ্কটকালে অভিজাত শ্রেণির ভূমিকাএ্যাংলো-মুঘল যুদ্ধ ও জব চার্নক কর্তৃক সুতানুটি কুঠি স্থাপন, (১৬৮৬-১৬৯০)
Englo-Mughal War and Establishment in Sutanati Kuthi by Jab Charnak (1686-1690)
মনে রাখা দরকার যে, ভারতে ইউরোপীয় পণ্যের চাহিদা ছিল না বলে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো এদেশের পণ্য ক্রয় করার জন্য স্বদেশ থেকে পণ্য না এনে স্বর্ণ-রৌপ্য আমদানি করতো, যা কিনা মুঘল সরকারের জন্য ছিল প্রকৃত স্বর্ণডিম্ব। এ ডিম্ব লাভের পথ সুগম রাখার লক্ষ্যেই মূলত সরকার কোম্পানিকে এদেশে নামেমাত্র বাৎসরিক শুল্কে (তিন হাজার টাকা) বাণিজ্য করার অধিকার দেয়। অপরদিকে কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স বঙ্গ-বাণিজ্যে বিনিয়োগ দিন দিন বৃদ্ধিলাভের প্রেক্ষিতে পুঁজির নিরাপত্তার খাতিরে বোম্বাই ও মাদ্রাজের মডেলে বাংলার উপকূল অঞ্চলের কোথাও একটি সুরক্ষিত সার্বভৌম বসতি স্থাপনের প্রয়োজন অনুভব করে। ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে বাংলার ব্যবসায় বাণিজ্য ব্যবস্থাপনার জন্য মাদ্রাজ থেকে আলাদা করে একজন গভর্নর নিযুক্ত করা হয়, যদিও তখন এদেশের ইংরেজের কোনো সুরক্ষিত বসতি ছিল না। উইলিয়াম হেজেজকে নিযুক্ত করা হয় প্রথম গভর্নর। তাঁর পদবি হয় ‘Governor Chief of the English East India Company in the Bay of Bengal.’ মুঘল নিয়ন্ত্রিত হুগলী বন্দরে তাঁর অফিস স্থাপিত হয়। হেজেজই প্রথম ব্যবসার স্বার্থে বাংলায় ব্রিটিশ সামরিক উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে হেজেজের স্থলে কোম্পানির বঙ্গোপসাগরীয় ব্যবসার ব্যবস্থাপনার জন্য ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন জব চার্নক। জব চার্নকের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, সুবা বাংলায় কোম্পানির রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হোক এবং ঐ উদ্দেশ্যেই তিনি ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম দখল করে সেখানে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের জন্য কোম্পানির মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদন লাভ করেছিলেন। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর এক স্কোয়াড্রন সৈন্য হুগলী আক্রমণ করে ১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে। প্রায় চার বছর পর্যন্ত যুধ্যমান সম্পর্ক চলে কোম্পানি ও সরকারের মধ্যে। নৌশক্তিবলে সমুদ্র বুকে কোম্পানি আধিপত্য বিস্তার করে এবং স্থল শক্তিবলে মুঘল সরকার ইংরেজদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু দীর্ঘকাল জলপথ অবরোধ করে রাখার ফলে সরকারের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত হচ্ছিল। এদিকে কোম্পানির ব্যবসায় বন্ধ থাকার ফলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ধাতব সম্পদ থেকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছিল। এসব দিক বিবেচনা করে ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ঔরঙ্গজেব সিদ্ধান্ত নেন বিবাদ বন্ধ করে ইংরেজদের দেশে ফিরিয়ে আনার। সম্রাট দ্বারা আদিষ্ট হয়ে সুবাদার ইব্রাহিম খান কোম্পানিকে বছরে থোক তিন হাজার টাকা পেশকাশ বা পুরস্কার প্রদান এবং বাধ্যভাবে ব্যবসায় করার অঙ্গীকারে বাংলায় বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার
পরোয়ানা জারি করেন এবং তদুপরি কোম্পানিকে সুতানুটিতে কোম্পানির প্রধান কুঠি স্থাপনের অনুমতি প্রদান করেন। কালক্ষেপণ না করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্রুত গতিতে সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে বাংলা সুবায় বাণিজ্য পুনর্বার চালু করে। হুগলি থেকে মূল কুঠি সুতানুটিতে স্থানান্তর করা হয় এভাবে স্থাপিত হয় ভারতে ব্রিটিশ
সাম্রাজ্যের ভিত।
দেশে ইংরেজ বণিকদের ফিরিয়ে আনার পশ্চাতে অর্থনৈতিক কারণ ছিল। ইউরোপীয়দের মাধ্যমে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য প্রসার পাচ্ছিল সন্দেহ নেই । কিন্তু মুঘল সরকারের ব্যর্থতা নিহিত অন্যত্র। লক্ষণীয় যে, বিগত যুদ্ধে নৌশক্তি প্রধান ভূমিকা পালন করলেও মুঘল সরকার নাওয়ারা বা নৌশক্তি প্রবল করার কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। নৌশক্তিবলে ইউরোপীয়দের ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আনাগোনা এবং সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নৌযুদ্ধের পরও মুঘল শাসকশ্রেণির মধ্যে আত্মরক্ষাচেতনা সৃষ্টি না হওয়া বিস্ময়কর বটে। অথচ আর্থিক ক্ষমতা ছিল, দেশে জাহাজ নির্মাণের সামগ্রী ছিল, জনসম্পদ ছিল এবং এমনকি ইউরোপীয় জাহাজ নির্মাণ কারিগর-প্রকৌশলী নিয়োগ করা যেতো। সে যুগে মুঘল সেনাবাহিনীতে অসংখ্য ইউরোপীয় সেনা ভাড়াটে হিসেবে চাকরি করতো। কিন্তু এর কোনো সুযোগই গ্রহণ করা হয়নি। ইউরোপীয়রা সহজেই ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পেল ।