কর্তৃত্ববাদ , রাজনীতি এবং সরকারে, কর্তৃত্বের কাছে অন্ধ বশ্যতা এবং চিন্তা ও কর্মের ব্যক্তি স্বাধীনতার দমন। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা হল সরকার ব্যবস্থা যাদের নির্বাহী ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য কোন প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা নেই এবং তাদের নাগরিকদের নাগরিক স্বাধীনতা বা রাজনৈতিক অধিকার বহন করে না । ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় একক নেতা বা ক্ষুদ্র অভিজাতদের হাতে, যাদের সিদ্ধান্ত জনগণের ইচ্ছার তোয়াক্কা না করেই নেওয়া হয়। কর্তৃত্ববাদ শব্দটি প্রায়শই গণতান্ত্রিক নয় এমন যেকোনো ধরনের সরকারকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে যে কর্তৃত্ববাদী শাসনের মধ্যে প্রচুর বৈচিত্র্য রয়েছে।
কর্তৃত্ববাদের বৈশিষ্ট্য: কর্তৃত্ববাদের কতকগুলি নীতি বা বৈশিষ্ট্যের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। কর্তৃত্ববাদ অনুসারে জনগণের উপর শাসক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সামগ্রিক ও নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা হয়। চরম রাজনীতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উপর শাসকের অবাধ অধিকারের কথা বলা হয়। শাসকের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন ও আনুগত্যের উপর জোর দেওয়া হয়। শাসকের কর্তৃত্বকে সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনমত রাজনীতিক মতাদর্শ ও তাত্ত্বিক ভিত্তি গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হয়। শাসক সম্প্রদায়ের সংকীর্ণ স্বার্থের অনুকূলে তাত্ত্বিক সমর্থন সংগঠিত করা হয়। অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, শিক্ষা-দীক্ষা প্রভৃতি সব কিছুকেই সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে নিয়ে আসা হয়। গণমাধ্যমসমূহ শাসকের কুক্ষিগত থাকে এবং সরকারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় স্বাধীনভাবে জনগণের মতামত প্রকাশের উপর কঠোর সরকারী নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। শাসক বা শাসকদলের বিরোধী সকল রাজনীতিক শক্তিকে নির্মূল করার ব্যবস্থা করা হয়।
কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার একাধিক রূপ: চরম রাজনীতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উপর নিরঙ্কুশ আধিপত্যের দাবি হল কর্তৃত্ববাদের মূল কথা। যে সমস্ত সরকারের মধ্যে এই দাবি বর্তমান থাকে সেই সমস্ত সরকারই হল কর্তৃত্ববাদী সরকার। সুতরাং কর্তৃত্ববাদের বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব বিভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থার মধ্যে থাকতে পারে। অর্থাৎ কতকগুলি শাসনব্যবস্থার এক বর্ণনাম হল কর্তৃত্ববাদ। কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থার মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য বড় একটা থাকে না। প্রকৃত প্রস্তাবে কর্তৃত্ববাদ বলতে কোন নির্দিষ্ট বা একক রাজনীতিক ব্যবস্থাকে বোঝায় না। কর্তৃত্ববাদের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থার মধ্যে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা বর্তমান থাকে। যাইহোক নিম্নলিখিত সরকারী ব্যবস্থাসমূহ কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা হিসাবে বিবেচিত হয়। এগুলি হল একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, সামগ্রিকতাবাদ প্রভৃতি। আবার উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার সৃষ্টি হতে পারে এবং হয়ও। এই রকম কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাকে শাসনতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র বলে। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন কারণে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার সৃষ্টি হতে পারে এবং শাসনতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রের পথ প্রশস্ত হতে পারে। প্রথমেই উল্লেখ করা দরকার যে দেশের আইনসভায় কোন একটি রাজনীতিক দলের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে সেই দল নিরঙ্কুশ রাজনীতিক কর্তৃত্বের অধিকারী হয়। এই অবস্থায় বিরোধী দল দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় হলে ক্ষমতাসীন দলের সামনে কোন কার্যকর রাজনীতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে না। আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষমতাসীন দল শাসন ও বিচার-বিভাগের যাবতীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগী হয়। জনগণের সামনে একটি মনগড়া রাজনীতিক মতাদর্শের দেওয়াল খাড়া করে ক্ষমতাসীন দলটি অবাধ রাজনীতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়। শাসকদল সব রকম রাজনীতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিরোধী মতামতকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে। গণমাধ্যমগুলিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। জরুরী অবস্থা সম্পর্কিত সাংবিধানিক বিধিব্যবস্থার অতিপ্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ করা হয়। ব্যক্তিবর্গের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা পদদলিত হয়। আইনের অনুশাসন অপসারিত হয় এবং ক্ষমতাসীন দলের স্বৈরী শাসন কায়েম হয়। কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার জন্য জনগণের রাজনীতিক দাবি-দাওয়াকে উপেক্ষা করা হয়। চরম রাজনীতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উপর নিরঙ্কুশ আধিপত্যকে অব্যাহত রাখার জন্য শাসকদল যে-কোন উপায় ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পিছপা হয় না।