ডেভিড হেল্ডের অনুসরণে সনাতনী গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

গণতন্ত্র সম্পর্কে আধুনিক রাষ্ট্রতাত্ত্বিকদের মধ্যে ডেভিড হেল্ড (David Held) একটি বিশিষ্ট নাম। গণতন্ত্র সম্পর্কিত ডেভিড হেল্ডের ধারণার পরিচয় পাওয়া যায় Models of Democracy শীর্ষক তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। গণতন্ত্র সম্পর্কিত হেল্ডের এই সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ রাষ্ট্রতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিশেষ আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। প্রাজ্ঞ এই আধুনিক রাষ্ট্রদার্শনিকের অভিমত অনুযায়ী গণতন্ত্র সম্পর্কিত ধারণার ক্ষেত্রে ঐকমত্যের বড়ই অভাব। বিবিধ পরস্পর বিরোধী চিন্তা-ভাবনার ভারে গণতন্ত্রের ধারণা ভারাক্রান্ত। গণতন্ত্রের অর্থ সম্পর্কে অতিরিক্ত জটিলতা বর্তমান। গণতন্ত্রের অর্থ ও পরিধি প্রসঙ্গে বিবিধ প্রশ্ন উঠে আসে। তাই গণতন্ত্রের ধারণাটি এক কথায় জটিল। ডেভিড হেল্ড বলেছেন: “The idea of democracy remains complex and contested.”।

ডেভিড হেল্ড গণতন্ত্রের বিভিন্ন রূপ বা মডেল সম্পর্কিত আলোচনার আগেই গণতন্ত্রের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ নির্ধারণে উদ্যোগী হয়েছেন। প্রাচীন কালে গ্রীস দেশে উদ্ভূত ‘গণতন্ত্র’ (democracy) শব্দটির উৎসগত অর্থ তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। ইংরেজি ‘ডিমোক্রেসি’ শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে দুটি গ্রীক শব্দের সমাহারে। সংশ্লিষ্ট গ্রীক শব্দ দুটি হল ‘ডেমস’ (Demos) ও ‘ক্রাটস’ (Kratos)। ‘ডেমস’ কথার অর্থ হল জনগণ এবং ‘ক্রাটস’ কথার অর্থ হল ‘শাসন’ বা ‘ক্ষমতা’। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ‘গণতন্ত্র’ বলতে জনগণের শাসনক্ষমতাকে বোঝায়। গ্রীক পণ্ডিত অ্যারিস্টটল কিন্তু গণতন্ত্র বলতে ‘বিশৃঙ্খল জনগণের শাসন কে বুঝিয়েছেন। তবে সূচনা কাল থেকেই গণতন্ত্রের সঙ্গে জনসাধারণের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারণা সংযুক্ত। কালক্রমে শাসনব্যবস্থায় জনসাধারণের সমানাধিকারের অর্থেই ‘গণতন্ত্র’ শব্দটির বিকাশ ও বিস্তার ঘটে।

ডেভিড হেল্ড গণতন্ত্রের অর্থ পর্যালোচনা করেছেন তিনটি ধারণার ভিত্তিতে। সংশ্লিষ্ট ধারণা তিনটি হল: (১) শাসন, (২) কার দ্বারা শাসন এবং (৩) জনগণ। গণতন্ত্র বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে তিনি এই তিনটি বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন এবং ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বিবিধ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। সংশ্লিষ্ট প্রশ্নগুলির উল্লেখ আবশ্যক। (১) শাসন বলতে কী বুঝতে হবে? শাসন বলতে কেবলমাত্র আইন-শৃঙ্খলা সংরক্ষণকেই বোঝায়? নাকি আর্থনীতিক ব্যবস্থা পরিচালনাকে বোঝায়? অথবা রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সম্পর্ক পরিচালনাকে বোঝায়? (২) আবার কার দ্বারা শাসন এই বিষয়টির পর্যালোচনার ক্ষেত্রেও জটিল প্রকৃতির বিবিধ বিষয় উত্থাপিত হয়। এই বিষয়গুলি হল: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধিতা ও দায়বদ্ধতার ভূমিকা কীরকম হবে? জনগণের শাসন মেনে চলা কি বাধ্যতামূলক? জনগণের শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণে অক্ষমদের ভূমিকা কী হবে? (৩) জনগণ বলতে কাদের বোঝাবে? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণের প্রকৃতি কী রকম হবে? গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সুফল সকলের কাছে সমানভাবে নিয়ে যাওয়া যাবে কি না? হেল্ড গণতন্ত্র বিষয়টির অর্থ অনুধাবনের ক্ষেত্রে এ রকম বহু ও বিভিন্ন প্রশ্নের অবতারণা করেছেন।

গণতন্ত্রকে সংগঠিত রাজনীতিক জীবনের একটি রূপ হিসাবে দেখা হয়। এ দিক থেকে গণতন্ত্রের উপযোগিতার ব্যাপারে বিশ্বাস ও সমর্থন ব্যাপক। অধুনা অধিকাংশ রাষ্ট্রই গণতান্ত্রিক। এতদসত্ত্বেও এই সমস্ত রাষ্ট্রের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিপন্ন হয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার আহত অবস্থা। গণতন্ত্র সম্পর্কে ঐতিহাসিক অনুসন্ধান ও পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে হেল্ড বলেছেন যে, গণতন্ত্র প্রসঙ্গে বড়ই কম বলা হয়েছে। অথচ রাজনীতিক লেখকরা গণতন্ত্রের তত্ত্ব ও প্রয়োগ প্রসঙ্গে অতিমাত্রায় মুখর। তবে অতি সাম্প্রতিককালে গণতন্ত্র প্রসঙ্গে ঐক্যবদ্ধ অঙ্গীকারের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে।

গণতন্ত্রের সম্যক অর্থের অনুসন্ধানে ডেভিড হেল্ড আত্মনিয়োগ করেছেন। গণতন্ত্র সম্পর্কে বিদ্যমান বিবিধ ধারণাসমূহকে মাথায় রেখে গণতন্ত্রের অর্থ অনুধাবনে অগ্রসর হয়েছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী গণতন্ত্রের ধারণাগত ইতিহাস বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। বামপন্থী, দক্ষিণপন্থী, মধ্যপন্থী প্রভৃতি নির্বিশেষে সকল রাজনীতিক গোষ্ঠী নিজেদের গণতন্ত্রী হিসাবে দাবি করে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমান রাজনীতিক ব্যবস্থাসমূহের মধ্যে নানা ক্ষেত্রে মৌলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। অথচ সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাই নিজেদের গণতন্ত্রী বলে জাহির করে। পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের, লাতিন আমেরিকার বা পৃথিবীর অন্যান্য রাজনীতিক ব্যবস্থা প্রসঙ্গে এ কথা প্রযোজ্য।

ডেভিড হেল্ডের মতানুসারে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি ও সংরক্ষণ সহজ ব্যাপার নয়, বিশেষ সমস্যাসংকূল বিষয়। এ প্রসঙ্গে তাঁর মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে হেল্ড বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস পর্যালোচনা করেছেন এবং ঐতিহাসিক নজির উত্থাপন করেছেন। তাঁর মতানুসারে গণতন্ত্রের ধারণা অনুধাবনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট চিন্তা-ভাবনা ও প্রায়োগিক ইতিহাস পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। ফ্যাসিবাদী ও নাৎসিবাদী আক্রমণের আঘাতে গণতন্ত্র বিধ্বস্ত হয়েছে। গণতন্ত্রের সৃষ্টি ও সংরক্ষণ সম্ভব হয়েছে সুগভীর আত্মত্যাগ ও সামাজিক সংগ্রামের মাধ্যমে। সামাজিক, রাজনীতিক ও আর্থনীতিক জীবনে গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার প্রভাব গভীর ও ব্যাপক হওয়া দরকার। তা হলে গণতন্ত্রের আদর্শ ও প্রয়োগ আগামী দিনে নিরুপদ্রব হবে।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Garden rooms & out buildings dm developments north west. Saraswat bank co operative ltd.  bob marley movie one love – official trailer 2024.