ফরাসি সমাজতান্ত্রিক লেখক আগস্ট ব্লাঙ্কিং ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম শিল্প বিপ্লব শব্দটি ব্যবহার করেন। ইংল্যান্ড ছিল বিশ্বের শিল্পবিপ্লবের পুরোধা। আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে শিল্প বিপ্লব শুরু হলেও দীর্ঘকাল ধরে প্রস্তুতির পর ইংল্যান্ড শিল্প বিপ্লবের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়।
(1) প্রাকৃতিক শক্তির ভূমিকা : ইংল্যান্ডের প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক পরিবেশ শিল্প বিপ্লবে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। এখানকার স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া ছিল বস্ত্রশিল্পের উপযুক্ত। কারণ এই আবহাওয়ায় বস্ত্রের উপাদান সূতা বোনার সময় হঠাৎ ছিঁড়ে যেত না। এছাড়াও ইংল্যান্ডের উত্তরদিকে অবস্থিত নদী ও জলপ্রপাতগুলির জলশক্তিকে কাজে লাগিয়ে যান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু রাখা সম্ভব হয়। এছাড়াও ইংল্যান্ডের ভূমধ্যস্থ অফুরন্ত কয়লা ও লোহা শিল্পের পরিকাঠামো গঠনে প্রভূত সাহায্য করেছিল।
(২) মূলধনের যোগান: যেকোনো শিল্প সংগঠন ও তার বিকাশে মূলধন অবশ্যই প্রয়োজন। আর এই প্রচুর মূলধনের যোগান দিয়েছিল বিভিন্ন ব্রিটিশ ব্যাঙ্কার, বণিক ও শিল্পপতিগণ। তাই মূলধনের সহজ যোগান থাকায় ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সম্ভব হয়েছিল।
(৩) বিভিন্ন যন্ত্রের আবিষ্কার : অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের বুকে কিছু উন্নত ধরনের যন্ত্রের আবিষ্কার হওয়ায় শিল্প বিপ্লব সহজ হয়। যেমন–১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে জন কে আবিষ্কার করেন ‘উড়ন্ত মাকু’। ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে হারগ্রীভস আবিষ্কার করেন ‘স্পিনিং জেনি’ নামক এক সূতা বুনবার যন্ত্র, ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে আর্করাইট আবিষ্কার করেন এক ধরনের জলশক্তি চালিত ‘বয়নযন্ত্র’। স্পিনিং জেনি ও ওয়াটার ফ্রেম এই দুটি যন্ত্রের মেলা বন্ধন ঘটিয়ে স্যামুয়েল ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কার করেন ‘মিউল’ নামে এক যন্ত্র। এই যন্ত্রে এক সঙ্গে সূতা তৈরি ও কাপড় বোনা সম্ভবপর হয়। এই সকল বিভিন্ন যন্ত্রের আবিষ্কার শিল্পবিপ্লব ঘটাতে সাহায্য করে।
(৪) পরিবহন ব্যবস্থা : শিল্পের ক্ষেত্রে পরিবহন ব্যবস্থা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই শিল্প বিপ্লবও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বের প্রথম আধুনিক রেলপথ ডারহ্যান থেকে স্টকটন বন্দর পর্যন্ত স্থাপিত হয়। রেল পরিবহন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে শিল্প বিপ্লব সম্পূর্ণতা পায়।
(৫) সুলভ দক্ষ শ্রমিক : বিভিন্ন শিল্প কারখানায় নিয়োজিত শিল্প শ্রমিকরা ছিল। অত্যন্ত দক্ষ। কাজের আশায় বহু শ্রমিক শিল্প কারখানায় যোগদান করায় শ্রমিক যোগানের সমস্যা দেখা যায়নি। নির্দিষ্ট মজুরির বিনিময়ে অজস্র শ্রমিক এই সকল শিল্পকারখানাগুলিতে কাজ করে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে খুবই উন্নত মানের শিল্পপণ্য উৎপাদন করে শিল্প বিপ্লব ঘটাতে সাহায্য করে।
(৬) কৃষির উন্নতি : অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে কৃষকরা কৃষি থেকে ভালো আয় করায় শিল্পদ্রব্য কেনার ক্ষমতা অর্জন করে। ফলস্বরূপ সমাজের একটি বিরাট অংশ কৃষক শ্রেণির সাহায্যে এক শিল্পকেন্দ্রিক বাজার গড়ে তোলা সহজ হয়। ফলে কৃষির ওপর ভিত্তি করে শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপট রচিত হয়।
(৭) উন্মুক্ত ও বিশাল বাজার : অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে উন্নত মানের পণ্য সামগ্রীগুলিকে বিক্রয় করার জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের প্রয়োজন ছিল। আবার ইংল্যান্ড, ইউরোপ, আফ্রিকা ও ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় উপনিবেশ স্থাপন করায় ইংল্যান্ডের এই বাজার তৈরি ছিল। ফলে এই বাজারে ইংল্যান্ডের শিল্পজাত পণ্য বিক্রয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব সম্ভব হয়।
ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের ফলাফল : ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলাফল নিম্নরূপ—
(ক) শিল্প সমাজের উদ্ভব : শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডে প্রযুক্তি কৌশল নির্ভর যান্ত্রিক উৎপাদন ও যন্ত্র সভ্যতার সূচনা হয়েছিল। এইভাবে ইংল্যান্ডে শিল্প সমাজের প্রতিষ্ঠা হয়।
(খ) নতুন শ্রেণি বিন্যাস : শিল্পবিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডে নতুন দুই শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। যথা—ফ্যাক্টরি মালিক বা পুঁজিপতি ও শ্রমিক শ্রেণি।
(গ) অর্থনৈতিক উন্নতি : শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডের জাতীয় অর্থনীতির উন্নতি ঘটে এবং ইংল্যান্ডের উপনিবেশের প্রসার ঘটে ও ইংল্যান্ড ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে পড়ে।
(ঘ) শহরের উদ্ভব : ইংল্যান্ডে ফ্যাক্টরি এলাকা ও বন্দর এলাকাকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন শহরের বিকাশ ঘটে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বার্মিংহাম, ব্রিস্টল, ম্যাঞ্চেস্টার প্রভৃতি।
মূল্যায়ন : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সরকারী তরফে পুঁজির লগ্নিকে উৎসাহ দান, সরকারি ঋণের উপর সুদের হার কমানো, বৈদেশিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণ এবং আমদানিকৃত পণ্যের উপর উচ্চহারে শুল্ক বসানোর দ্বারা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব সম্ভব হয়।