ষোড়শ শতকে জার্মানি থেকে ধর্মসংস্কার আন্দোলন ধীরে ধীরে ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই দেশগুলিতে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমত সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্র সম্পর্কিত নীতি, আর্থিক কার্যকলাপ, মানবিক চেতনা, নীতিবোধ, ধর্মীয় ভাবনা—এই সমস্ত কিছুই ধর্মসংস্কারের অভিঘাতে বদলাতে শুরু করে। ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রভাব বা ফলাফলগুলি নিম্নরূপ
➤(১) খ্রিস্টান জগতের বিভাজন : ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলে পশ্চিম ইউরোপের খ্রিস্টান জগত দুটি পরস্পর বিরোধী শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। একদিকে থাকে পোপপন্থী রোমান ক্যাথলিক ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন প্রভৃতি দেশ। অপরদিকে থাকে পোপবিরোধী প্রোটেস্ট্যান্টপন্থী জার্মানি, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও উত্তর ইউরোপের নানান দেশ
➤ (২) ধর্ম ও রাজনীতির পৃথকীকরণ: ধর্মসংস্কারের প্রভাবে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে চার্চের ওপর রাষ্ট্রের জয় সূচিত হয়। ধর্মনীতি ও রাজনীতির মধ্যে স্পষ্ট সীমারেখা টানা হয়। ধর্মীয় প্রধানদের রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বন্ধ করা হয়।
➤ (3) জাতীয় চেতনার প্রসার : প্রোটেস্ট্যান্টদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের সুফল হিসেবে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে জাতীয় চেতনার প্রসার ঘটতে শুরু করে। এক দেশে এক ভাষা, ঐক ঐতিহ্য, এক সংস্কৃতি—এই আদর্শের উদ্ভব ঘটে। এর পাশাপাশি ইউরোপ জুড়ে পোপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাষ্ট্রীয় চার্চ গড়ে উঠতে শুরু করে।
➤ (৪) ধর্মীয় উদারতার প্রসার : ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলে ধর্মীয় ক্ষেত্রে জাতীয় অন্ধত্ব ও কুসংস্কারের জাল ছিন্ন হতে থকে। সাধারণ মানুষ অনুভব করতে শুরু করে যে ধর্মসাধনায় কেবলমাত্র একটি মত ও পথ চূড়ান্ত বা শেষ কথা হতে পারে না। পশ্চিম ইউরোপের কমবেশি সমস্ত দেশেই গড়ে ওঠে ধর্মীয় সহনশীলতা ও উদারতার পরিবেশ।
➤ (৫) ব্যক্তি স্বাধীনতা ও যুক্তিবাদীদের বিকাশ : ধর্মসংস্কার আন্দোলন সাধারণ মানুষের জীবনকে চার্চের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করায় ব্যক্তি স্বাধীনতার বিকাশ ঘটে। অষ্টাদশ শতকে যে যুক্তিবাদী যুগের সূচনা হয়, তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে ধর্মসংস্কার আন্দোলন।
➤ (৬) প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের উদ্ভব : ধর্মসংস্কার আন্দোলনের তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল হিসেবে ক্যাথলিক ধর্মের মধ্যেও সংস্কার প্রচেষ্টা দেখা দেয়, যা ইতিহাসে প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলন নামে পরিচিত। প্রোটেস্ট্যান্টদের অগ্রগতি প্রতিরোধ করতে এবং রোমের চার্চগুলির মহিমাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনার জন্য এই আন্দোলন শুরু হয়।
➤ (৭) পুঁজির উদ্ভব : ক্যাথলিক ধর্মে ঋণদান বা সুদ গ্রহণ করা ছিল পাপ। ধর্মসংস্কার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এসব ক্ষেত্রে বিরোধিতা না করায় পশ্চিম ইউরোপে পুঁজির উদ্ভব ও বিকাশ শুরু হয়। ফলে ধনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে আর তেমন কোনো বাধা রইল না।
➤ (৮) ধর্মীয় ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা : চার্চ ও রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় চাৰ্চতন্ত্র ক্রমশ পিছু হটতে থাকে। প্রোটেস্ট্যান্ট দেশগুলিতে চার্চের ওপর রাষ্ট্রের জয় সূচিত হয়। এছাড়াও এই দেশগুলিতে রাজারাই চার্চের প্রধান হয়ে ওঠেন।
➤ (৯) পবিত্র ধর্ম আদালত : ক্যাথলিক ধর্ম বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করতে ও নাস্তিকদের শাস্তি দিতে পবিত্র ধর্ম আদালত গঠিত হয়েছিল। এই আদালতের একমাত্র কাজ ছিল অবিশ্বাসীকে খুঁজে বের করে তাকে শাস্তি প্রদান করা। এই শাস্তি ছিল কারাদণ্ড, জোর করে অত্যাচারের মাধ্যমে স্বীকৃতি আদায়, প্রাণদণ্ড প্রভৃতি। এই আদালত অনেক আগে থেকে প্রচলিত থাকলেও কাউন্সিল অব ট্রেন্ট সভার পর থেকে এটি খুব সক্রিয় হয়ে ওঠে।