‘নারীবাদ’ বলতে কি বোঝায় | নারীবাদী আন্দোলনের উদ্দেশ্য কি | আলোচনা কর | What is feminism? Explain the objectives of the feminist movement

নারীবাদ বলতে কি বুঝায় :-

ভূমিকা : নারীবাদী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হলো সমগ্র বিশ্বে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এই লক্ষ্যে যারা কাজ করে থাকেন তাদেরই নারীবাদী বলা হয়। 

পুরুষেরাও নারীবাদী হতে পারে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এ বৈপ্লবিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। প্রথম প্রবাহের নারীবাদীদের মধ্যে মেরী ওলস্টোন ক্রাফট, জন স্টুয়ার্ট মিল, হ্যারিয়েট টেইলর প্রমুখ ব্যক্তিত্ব উল্লেখযোগ্য ।

নারীবাদ শব্দের উৎপত্তি : নারীবাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Feminism’। যা গ্রীক শব্দ ‘Femme’ থেকে এসেছে। যার অর্থ নারী 

নারীবাদ : ‘নারীবাদ’ শব্দটি বিভিন্ন সময় ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে নারীবাদের সর্বজনীন সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়া যায় না। 

উনিশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ফরাসি সমাজতন্ত্রী চার্লস ফুরিয়ের “Feminism” শব্দটি আবিষ্কার করলেও ১৮৮০ দশকে “French Women’s Suffrage Society’-এর প্রতিষ্ঠাতা হুবারটিন অকলার্টি’ নারীবাদ/Feminism শব্দটি ব্যবহার করেন ।

সাধারণ অর্থে নারীবাদ হলো এমন এক মতবাদ যা নারীর ওপর সমাজ, রাষ্ট্র তথা পুরুষের আধিপত্য, নিপীড়ন, এর কারণ ও ফলাফল এবং নারী মুক্তির কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করে ।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা /তাত্ত্বিকদের মতামত : নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো :

রোজালিড ডেলমার ‘What is feminism; গ্রন্থে বলেন, “সাধারণভাবে নারীবাদ হলো সমাজে নারী অবস্থান পরিবর্তনের জন্য সক্রিয় আগ্রহ।”

নারীবাদী আন্দোলনের উদ্দেশ্য :-

“দয়া নয় পৃথিবী চায় ন্যায় বিচার” আধুনিক নারীবাদের জনক মেরি ভলস্টন ক্রাফট এর এই উক্তিতে নারীবাদের উদ্দেশ্য ও নারীর প্রতি অন্যায়ের চিত্র উঠে এসেছে । তিনি নারীর প্রতি পুরুষের করুনা নয় , চেয়েছেন ন্যায় বিচার ও নারীর ন্যায্য অধিকার ।নারীর প্রতি বৈষম্যের ইতিহাস প্রাচীন । পরিবারে নারী ও পুরুষের ভূমিকা শ্রম বৈষম্যের চেয়ে পুরনো ।এটিই সবচেয়ে প্রাচীন বৈষম্যমূলক সামাজিক শ্রেনী বিভাগ । লিংগ ও বর্ণ এর মত শারীরিক পার্থক্যগুলোকে ঐতিহ্যগতভাবে সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অসমতা, বৈষম্য, অধীনতা ও নির্যাতনের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে । নারী নির্যাতন ও নারীকে পুরুষের অধীন করে রাখা হলো সবচেয়ে পুরনো সামাজিক বৈষম্যমূলক চর্চা । নারীর নির্যাতিত হওয়ার দীর্ঘ ইতিহাসে নারীরা বিভিন্নভাবে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে । এই অধিকার আদায় ও নারীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই হল নারীবাদী আন্দোলনের উদ্দেশ্য।

সামাজিক, রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে লৈংগিক সমতায় বিশ্বাস এর ভিত্তিকে কেন্দ্র করেই নারীবাদী আন্দোলন দানা বাধে। নারীবাদীরা সমাজে নারীর নারীর সমান অধিকার পাওয়ার জন্য লড়াই করেন। তাদের প্রধান দাবী হল সমাজের সুযোগ সুবিধা ও গুরুত্বপূর্ন উপাদানগুলোতে নারীর সমান অধিকার থাকতে হবে । এই আন্দোলন মনে করে সমাজের গুরুত্বপূর্ন উপাদানগুলোর একটি বড় অংশ নারীদের জন্য বরাদ্দ করতে হবে। বৈষম্যমূলক আচরন থেকে মুক্তি ও সমাজের সকল ক্ষেত্রে নারীদের প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই আন্দোলন উনিশ শতকে শক্ত কাঠামো পায় ।নারীর তার নিজের জীবনের উপর, পছন্দের উপর কর্তৃ্ত্ব ও বিশ্বব্যাপী নারীর ক্ষমতায়ন ও পুরুষের একক কর্তৃ্ত্বের পরিবর্তনই নারীবাদের প্রধান লক্ষ্য ও উদেশ্য ।সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পুরুষের একক কর্তৃত্ব হ্রাস করে সমাজের সকল ক্ষেত্রে লৈংগিক সমতায় বিশ্বাস করে যে আন্দোলন তাই নারীবাদ।

কাল্পনিক সমাজবাদী ও ফ্রান্সের দার্শনিক চার্লস ফুয়েরার ১৮৩৭ সালে ‘নারীবাদ’ শব্দটি সর্ব প্রথম ব্যবহার করেন। ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ড এ ১৮৭২ সালে ‘নারীবাদ’ ও ‘নারীবাদী’ শব্দ দুইটি ব্যবহার শুরু হয়। ব্রিটেনে ১৮৯০ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১০ শব্দ দুইটির ব্যবহার শুরু হয় ।১৮৫২ সালে ‘নারীবাদী’ এবং ১৮৯৫ সালে ‘নারীবাদ’ শব্দ দুইটির প্রথম ব্যবহার শুরু হয়েছে বলে অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে উল্লেখ করা হয়েছে । নারীবাদ ও নারীবাদী শব্দ দুইটি নতুন হলেও নারীর অধিকারের পক্ষে যে আন্দোলন তার বীজ বপীত হয়েছিল প্রাচীন গ্রীসে। ২৪ শতক পূর্বে প্লেটো নারীর অধিকারের পক্ষে বলেছিলেন, যে সব নারী যুদ্ধ ও শাসন করতে পারবে তারা উচ্চ শ্রেনীতে স্থান পাবে । ফ্রান্সের লেখক Christine de Pisan(১৩৬৪-১৪৩০) তার বই “The book of the city of  ladies” এ প্রথম নারীর প্রতি ঘৃণা ও লৈঙ্গিক সম্পর্ক নিয়ে লেখেন ।

বিভিন্ন সময়ে কিছু লেখক নারীর অধিকার নিয়ে লিখলেও নারীবাদ বলতে যা বুঝায় তা শুরু হয়েছিল ১৯শতকে ইউরোপে ।  এই সময়ে দেশে দেশে বিভিন্ন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সামনে রেখে অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু হয়। উনিশ শতকে ইউরোপে,

১) বিবাহিত নারীরা মূলত আইনের চোখে মৃত ছিল অর্থাৎ তার স্বামী বা পরিবারের বাইরে তার স্বাধীন কোন অস্তিত্ব ছিল না।

২) নারীদের আইন তৈরিতে কোন ভূমিকা ছিল না অথচ তাদের আইন মানতে হত।

৩) বিবাহিত মহিলাদের সম্পত্তির অধিকার ছিল না।

৪)  স্বামীদের আইনগত অধিকার ছিল  স্ত্রীদের জেলে দেওয়ার বা নির্দয় প্রহার করার ।

৫)নারীর মজু্রি ছিল পুরুষের তুলনায় অতি নগন্য।

৬) আইন বা ডাক্তারির মত অধিকাংশ পেশায় নারীদের যোগদানের অনুমতি ছিলনা।

নারীদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক শোষনের মাধ্যমে পুরুষের উপর নির্ভরশীল করে রাখা হয়েছিল। এমন অবস্থায় ভোটের অধিকার‌ পাবলিক অফিসে যোগদানের অধিকার, কাজ, ন্যায্য মজু্রি, সম্পত্তির মালিকানা, শিক্ষা, বিবাহে সমান অধিকার ও মাতৃত্বকালীন ছুটির জন্য শুরু হয়েছিল নারীদের আন্দোলন। যৌন নির্যাতন থেকে নারী ও শিশুদের রক্ষার দাবী ও এতে স্বল্প পরিসরে যুক্ত হয়েছিল । এই আন্দোলনের ইতিহাসই নারীবাদের ইতিহাসের প্রধান অংশ।

আধুনিক নারীবাদের ইতিহাসকে মূলত তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়, প্রত্যেক ভাগে নারীর অধিকার আদায় এর ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভংগিতে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।

  • উনবিংশ শতকের শেষ ও বিংশ শতকের শুরুর সময় হল প্রথম ভাগ ।
  • ১৯৬০-১৯৮০ হল দ্বিতীয় ভাগ।
  • ১৯৯০- বর্তমান পর্যন্ত হল তৃতীয় ভাগ।

ভোট প্রদানের দাবীকে কেন্দ্র করে প্রথম ভাগের আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। টাইম মাগ্যাজিন ঘোষিত বিংশ শতাব্দীর ১০০ প্রভাবশালী মহিলার একজন Emmeline Pankhurst  উনবিংশ শতকের শুরুতে নিজের বাড়ি বিক্রি করে ব্রিটেন ও ইউরোপে আন্দোলন পরিচালনা করেন। নেদারল্যান্ডে Willhelmina Drucker(1847-1925) ভোট ও সমানাধিকার বিষয়ে আন্দোলন করেন । তিনি এই লক্ষ্যে অনেক নারীবাদী সংগঠন গড়ে তোলেন । ঐ সময় ফরাসি স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাইমন ভেল  মেয়েদের পিল ব্যবহার সহজলভ্য ও গর্ভপাত বৈধ করেন । উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দিতে নারীবাদীরা ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে বিয়ে, অভিভাবকত্ব সম্পত্তির অধিকারের দাবীর উপরও জোর দিয়েছিল । উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের দিকে এই আন্দোলন চালিত হয়েছিল । ভোটাধিকার অর্জন ছিল এর প্রধান লক্ষ্য। এর পাশাপাশি যৌন ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলোও অল্প পরিসরে আলোচিত হয়েছিল। এই আন্দোলনের ফলে ইতিহাসে প্রথম ১৮৯৩ সালে নিউজিল্যান্ড নারীদের ভোটাধিকার দেয়। ১৯০২ সালে দেয় অস্ট্রেলিয়া। ব্রিটেন ১৯১৮ সালে যাদের বয়স ৩০এর বেশি ও সম্পত্তির মালিক তাদের এবং পরে ১৯২৮ সালে ২১ বছরের বেশি বয়সী সকলের ভোটাধিকার দিয়েছিল । যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১৯ সালে নারীরা ভোটাধিকার পায়।

দ্বিতীয়ভাগে নারীর স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই সময় নারীর আইনি ও সামাজিক সমতার ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে উঠে ।এই সময় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত মনে করা হয় এবং এতে নারীর অংশ গ্রহনের উপর জোর দেওয়া হয়। এই সময় carol hanisch এর ” ব্যক্তিগত বিষয়গুলোও রাজনৈতিক বিষয়” স্লোগানটি আন্দোলনের সমার্থক হয়ে উঠে।

তৃতীয় ভাগ আন্দোলন শুরু হয় আমেরিকাতে ।এই আন্দোলন মূলত ছিল দ্বিতীয় ভাগের গতি ধরে রাখার আন্দোলন। এই সময় যৌন বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠে।  এই আন্দোলন নারী লিংগকে ক্ষমতায়নের শক্তি হিসেবে দেখেছিল। এই সময়ে এসে নারীবাদী আন্দোলন দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পরে। একদল মনে করে নারী ও পুরুষের লিংগের পার্থক্য বিবেচনায় নিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে অন্য দলটি মনে করে এই পার্থক্য বিবেচনায় না নিয়েই ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে । এই আন্দোলন এখনও চলমান  রয়েছে।

বর্তমানে উত্তর নারীবাদ নামে একটি নতুন ধারার সৃষ্টি হয়েছে। এরা মনে করেন যে লৈংগিক সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তারা মনে করেন আমরা এখন এমন এক সমাজে বসবাস করছি যেখানে লৈংগিক আলোচনা অর্থহীন। Amelia jones  নামে একজন লেখক মনে করেন আমরা এখন উত্তর নারীবাদ সমাজে বসবাস করছি যেখানে লৈংগিক সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তাই লিংগ বিষয়ক আন্দোলন অর্থহীন।

উত্তর নারীবাদের ধারণা আকর্ষনীয় কিছু ক্ষেত্রে নারীর অধিকার অর্জিত হলেও নারী ও পুরুষের  লিংগ ভিত্তিক সমতা অর্জিত হয়েছে এ কথা বলা যাবে না। বর্তমান সময়ে তাই নারীবাদী আন্দোলন উত্তর নারীবাদ ও আধুনিক নারীবাদ এই দুই বিপরীত ধারনার বিরোধপূর্ণ একটি সময়। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আধুনিক নারীবাদীদের সমতার  প্রাথমিক দাবীগুলো কিছু উন্নত দেশে প্রতিষ্ঠিত হলেও অধিকাংশ দেশেই এগুলো এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি ।  উত্তর নারীবাদীদের দাবীগুলো তাই সামগ্রিক বিচারে যৌক্তিক নয় এবং তাই বর্তমান সময়েও আধুনিক নারীবাদীদের দাবিগুলো প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কোন বিকল্প নেই।



মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Why national building regulations. General dm developments north west.