গান্ধীজির মতে,সর্বোদয় আন্দোলন সর্বোদয় সম্পর্কে গান্ধিজীর চিন্তাধারা ব্যাখ্যা করো

সর্বোদয় সম্পর্কে গান্ধীজীর চিন্তাধারা –

জন রাস্কিনের লেখা ‘নামক গ্রন্থ থেকে গান্ধীজী সর্বোদয় ভাবনার জন্য অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। ‘সর্বোদয়’ শব্দটি ‘সর্ব’ এবং ‘উদয়’ -এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে, যার আক্ষরিক অর্থ হল সকলের কল্যাণসাধন। 

সর্বোদয়ের অর্থ  সর্বোদয়ের অন্তর্নিহিত অর্থ গান্ধীজী তুলে ধরেছিলেন ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে। গান্ধীজী এতে বলেছেন যে, সকলের কল্যাণের মধ্যেই নিজের কল্যাণ নিহিত। জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে সকল মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে, তাই একজন উকিল এবং একজন নাপিতের কাজের মূল্য একই। গান্ধীজীর সর্বোদয় তত্ত্বে যেহেতু শ্রমের মূল্য সবচেয়ে বেশি তাই শ্রমভিত্তিক জীবনই হল আদর্শ জীবন। 

সর্বোদয়ের ভিত্তি  সর্বোদয় সমাজের মূল ভিত্তি হল প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা। এই সমাজে সবল হবে দুর্বলের রক্ষক এবং এই সমাজে কেউ জাতিকে অবদমন করবে না বা শোষণ করবে না। সেজন্য ঊনবিংশ শতাব্দীতে চারিদিকে উচ্চারিত হতে থাকে, ‘বেশি সংখ্যক মানুষের বেশি সংখ্যক কল্যাণ’ -এর কথা। গান্ধীজী তাঁর সর্বোদয় তত্ত্বে সকলের কল্যাণের কথা বলেছেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্র, অভিজাত-অভাজন, স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য নির্বিশেষে সকল মানুষই সর্বোদয় সমাজের সদস্য এবং এই সমাজে সকলেই সমানভাবে শ্রদ্ধার পাত্র, সকলেই সমান। এজন্য গান্ধীজী মনে করেন, সর্বোদয় সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য চাই সদ্ উপায়।

সর্বোদয়ের আদর্শ  গান্ধীজীর মতে সর্বোদয় সমাজের কিছু আদর্শ আছে। যেগুলি নিন্মে আলোচনা করা হল –

     (i) গ্রামীণ জীবনে গুরুত্ব  গান্ধীজী মনে করেন, ভারতীয় জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হল গ্রাম। দারিদ্রতা এবং শোষণ গ্রামীণ মানুষের জীবন আষ্ঠে-পৃষ্ঠে বেধে রেখেছে। গ্রামীণ মানুষকে এইসব দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারবে একমাত্র সর্বোদয়। কারণ গ্রামীণ ব্যবস্থায় রাষ্ট্র থাকলে তার প্রকৃতি পাল্টে যাবে এবং গড়ে উঠবে এমন এক রামরাজ্য যেখানে সকল মানুষের জীবন হবে সহজ-সরল ও শান্তিময়।

     (ii) নৈতিক আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন  সাধারণত মানুষ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক উপরে উঠতে চায় কিন্তু সর্বোদয় সমাজ মানুষকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন থেকে আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে নিয়ে যেতে চায়। সর্বোদয়ের লক্ষ্য হল সত্য, অহিংসা ও সৎ উপায়ের মধ্যে দিয়ে একটি উন্নত ও নৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে থাকবে প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা, অনুভূতি ও সহযোগিতা।

      (iii) আত্মত্যাগ  সর্বোদয়ের এক মহান আদর্শ হল আত্মত্যাগ। আত্মসুখ এবং আত্মবর্ণের কোন স্থান সর্বোদয়ে নেই। সর্বোদয় মতে দুঃখকষ্টকে জয় করতে হলে অপরের জন্য নিজেকে নিয়োগ করতে হবে। এর ফলে সকলের মধ্যে এক মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে। সর্বোদয় সমাজ একদিকে যেমন আত্মত্যাগের কথা বলেছে, অন্যদিকে তেমনই আদান করার পরিবর্তে প্রদান করার মনোভাব পোষণ করেছে। গান্ধীজীর মতে প্রত্যেকে তার সামর্থ অনুযায়ী কাজ করবে এবং কাজ শেষে সে তাঁর প্রয়োজন অনুযায়ী পাওনা পাবে।

     (iv) অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস  সর্বোদয় সমাজে প্রত্যেকেই সমাজের উন্নতির জন্য সমান সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে। এর ফলে সমাজ থেকে অর্থনৈতিক বৈষম্য বিদায় নেবে। গান্ধীজীর মতে সমাজে কৃষি এবং শিল্প পরস্পরের পরিপূরক হবে। এই সমাজে সম্পত্তির জাতীয়করণ ঘটবে না বরং সম্পত্তির অছি ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হবে।

     (v) দলহীন গণতন্ত্র  মানুষের অর্থনৈতিক মঙ্গলের উদ্দেশ্যে ভূমিহীনদের ভূমি দান করার কথা সর্বোদয় সমাজে বলা হয়েছে। সর্বোদয় মতে গণতান্ত্রিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটবে না। গান্ধিজী ভৌগলিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেছেন কারণ রাজনীতিবিদদের দাপট সর্বদাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিলক্ষিত হয়। তিনি বলেছেন সর্বোদয় সমাজ হবে শ্রেণিহীন সমাজ যে সমাজে শ্রেণি সংঘাত শূন্য হবে। কাজেই বলা যায় এই ধরনের গণতন্ত্র হল একটি দলহীন গণতন্ত্র।

সমালোচনা  সর্বোদয় সম্পর্কে গান্ধিজীর চিন্তাভাবনা নৈতিক হলেও বিভিন্নদিক থেকে এই তত্ত্ব সমালোচিত হয়েছে। যেমন –

     (i) কাল্পনিক  সর্বোদয়ের আলোচনায় গান্ধীজী সমাজকে একটি ব্যক্তিচরিত্রের ওপর দাঁড় করিয়েছেন। তিনি ব্যক্তির মহৎ গুণগুলিকেই নির্বাচন করেছেন কিন্তু মানুষের খারাপ গুণগুলি কীভাবে বর্জন করা হবে, সে ব্যাপারে তিনি কোন মন্তব্য করেননি।

     (ii) বিকেন্দ্রীকরণে অসংগতি  গান্ধিজী তাঁর সর্বোদয় তত্ত্বে বিকেন্দ্রীকরণের কথা ঘোষণা করেছেন। আধুনিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের সাথে গান্ধিজীর সর্বোদয় ধারনার অমিল খুঁজে যায়। তাছাড়া তিনি যে ভৌগলিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেছেন, তার দ্বারা সর্বোদয় সমাজের সব প্রয়োজন মেটানো সম্ভব নয় কারণ সমাজে ভালোর পাশাপাশি খারাপেরও বসবাস থাকে।

     সবশেষে বলা যায় যে, গান্ধিজীর সর্বোদয় দর্শনে আদর্শগত মূল্য বিদ্যমান। তাঁর অহিংসা ও সত্যের দ্বারা বিশ্বের বহু সমস্যার সমাধান সম্ভব কিন্তু সব সমস্যার সমাধান কখনোই সম্ভব নয়।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Safety & security dm developments north west. Sana wallpaper & carpet pen raigad. Tu aata hai seene mein in english.