কর্তৃত্ব সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত টীকা লেখ।

কর্তৃত্ববাদ (Authoritarianism) এমন একটি মতাদর্শ যেখানে একক ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের পরিবর্তে কর্তৃত্ব বা কর্তৃপক্ষের প্রতি অন্ধ আনুগত্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। সরকার বা শাসনব্যবস্থায় কর্তৃত্ববাদ বলতে এমন এক ধরনের সরকারকে বোঝায়, যাতে শাসনক্ষমতা একজন নেতা বা একটি ক্ষুদ্র অভিজাত গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত থাকে যারা সাংবিধানিকভাবে জনগণের কাছে কোনও জবাবদিহি করে না। এই ধরনের শাসনব্যবস্থার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি হল রাজনৈতিক বহুত্বের প্রত্যাখ্যান, বিদ্যমান রাজনৈতিক অবস্থা সংরক্ষণ করার জন্য শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার এবং আইনের শাসন, ক্ষমতার পৃথকীকরণ ও গণতান্ত্রিক ভোটদানের মাত্রা হ্রাসকরণ। কর্তৃত্ববাদী নেতারা বিদ্যমান আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে স্বেচ্ছাচারীভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ করেন। তাদেরকে নির্বাচনের মাধ্যমে বহু বিভিন্ন প্রতিযোগীদের মধ্যে থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয় না। এমনকি শাসকগোষ্ঠীর সাথে ক্ষমতার লড়াইয়ে প্রতিযোগী হতে পারে, এমন কোনও বিরোধী দল বা বিকল্প কোনও রাজনৈতিক গোষ্ঠী সৃষ্টির স্বাধীনতা হয় অত্যন্ত সীমিত থাকে কিংবা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থাকে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সরকারের কর্তৃত্ববাদী রূপগুলির প্রকারভেদ বর্ণনা করে বহুসংখ্যক শ্রেণীবিন্যাস সৃষ্টি করেছেন। কর্তৃত্ববাদী সরকার বা শাসনব্যবস্থাগুলি স্বৈরতান্ত্রিক হতে পারে, কিংবা গোষ্ঠীশাসনতান্ত্রিক হতে পারে, এটি কোনও আধিপত্য বিস্তারকারী রাজনৈতিক দল কিংবা সামরিক একনায়কের শাসনের উপর ভিত্তি করে ঘটতে পারে।[২][৩] যেসব রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদের মধ্যে কোনও সুস্পষ্ট সীমারেখা নেই, সেগুলিকে কদাচিৎ “সংকর গণতন্ত্র”, “সংকর শাসনব্যবস্থা” বা “প্রতিযোগিতামূলক কর্তৃত্ববাদী” রাষ্ট্র হিসেবে চরিত্রায়িত করা হতে পারে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হুয়ান লিনৎস ১৯৬৪ সালে রচিত তাঁর প্রভাবশালী অ্যান অথরিটেরিয়ান রেজিম: স্পেন (An Authoritarian Regime: Spain) নামক গ্রন্থে কর্তৃত্ববাদের নিচের চারটি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন:

সীমিত রাজনৈতিক বহুত্ব, যা আইনসভা, রাজনৈতিক দল ও স্বার্থগোষ্ঠীর উপর বাধানিষেধ আরোপ করে।

শাসনব্যবস্থাটির রাজনৈতিক বৈধতার ভিত্তি হল আবেগমূলক যুক্তিদোষ এবং “সহজেই শনাক্তযোগ্য সামাজিক সমস্যা, যেমন অনুন্নয়ন বা বিদ্রোহের (insurgency)” বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শাসনব্যবস্থাটিকে একটি প্রয়োজনীয় দুষ্টশক্তি হিসেবে পরিচিতি দেওয়া।

রাজনৈতিক সমবেতকরণ যথাসর্বোচ্চ কম রাখা এবং শাসনব্যবস্থা বিরোধী কর্মকাণ্ড দমন করা।

নির্বাহী ক্ষমতার সুস্পষ্ট সংজ্ঞা না থাকা। ফলে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতার সম্প্রসারণ ঘটে।

ন্যূনতম সংজ্ঞানুযায়ী একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার বা শাসনব্যবস্থায় আইনসভার উন্মুক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক সরাসরি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না এবং/অথবা নির্বাহী বিভাগের জন্য কোনও উন্মুক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক সরাসরি বা পরোক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। আরও ব্যাপক একটি সংজ্ঞা অনুযায়ী যেসব দেশে নাগরিক অধিকার যেমন ধর্মচর্চার অধিকার থাকে না, কিংবা যেসব দেশে একাধিক উন্মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার পরেও সরকার ও বিরোধী দল অন্তত একবারের জন্য ক্ষমতার হাতবদল করে না, সেগুলিকে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা হিসেবে অভিহিত করা যায়। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলিতে নামমাত্রে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে, যেমন রাজনৈতিক দল, আইনসভা ও নির্বাচন থাকতে পারে, কিন্তু সেগুলিকে এমনভাবে পরিচালনা করা হয়, যাতে কর্তৃত্ববাদী শাসনের শেকড় আরও গভীর হয়। এমনকি প্রতিযোগিতাবিহীন ও ভুয়া নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হতে পারে। একটি গবেষণাসূত্রমতে ১৯৪৬ সালের পর থেকে ১৯৭০-এর দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং এরপর ২০০০ সাল পর্যন্ত এগুলির সংখ্যা আবার হ্রাস পায়। ২০শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে লাতিন আমেরিকার পশ্চিমাপন্থী সামরিক স্বৈরশাসক সরকারগুলিকে কিছু বিশেষজ্ঞ কর্তৃত্ববাদী সরকারের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

কর্তৃত্ববাদ হল গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত একটি নীতি বা রাষ্ট্রব্যবস্থা। তবে এটির সাথে একচ্ছত্রবাদের পার্থক্য আছে। একচ্ছত্রবাদের মতো এটিতে কোনও উচ্চমাত্রায় বিকশিত পথনির্দেশক ভাবাদর্শ থাকে না, এটিতে সামাজিক সংগঠনে অল্প হলেও বহুত্ব মেনে নেওয়া হয়, এটি সমগ্র দেশবাসীকে জাতীয় লক্ষ্যের পেছনে নিয়োজিত করার জন্য উদ্বুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে না, বরং আপেক্ষিকভাবে আগে থেকেই এগুলির ক্ষমতার সীমা আঁচ করা যায়।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

National building regulations (sa). Saraswat bank co operative ltd. Garden rooms dm developments north west.