কনিষ্কের কৃতিত্ব পর্যালোচনা কর।

কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের কৃতিত্ব প্রসঙ্গে সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি, কুষাণ সাম্রাজ্যের ভারতীয়করণ, বাণিজ্যের উন্নতি, বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার, সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা ও সাহিত্যে অবদান সম্পর্কে জানবো।

কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের কৃতিত্ব

ঐতিহাসিক ঘটনাকণিষ্কের কৃতিত্ব
সাম্রাজ্যকুষাণ সাম্রাজ্য
প্রতিষ্ঠাতাকুজুল কদফিসেস
শ্রেষ্ঠ রাজাকণিষ্ক
শেষ রাজাদ্বিতীয় বাসুদেব

কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের কৃতিত্ব

ভূমিকা :- বিম কদফিসেস -এর মৃত্যুর পর কুষাণ সাম্রাজ্যে ভাঙ্গন দেখা দেয়। কনিষ্ক ক্ষমতায় এসে এই ভাঙ্গন রোধ করে কুষাণ সাম্রাজ্যে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। বিজেতা হিসেবে ইতিহাসে খ্যাতি পেয়েছেন কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক।

কুষাণ সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি

  • (১) তিনি বিম কদফিসেসের সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার লাভ করে ব্যাকট্রিয়া থেকে ভারত -এর উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত এক সাম্রাজ্য লাভ করেন। তিনি বাহুবলে এই সাম্রাজ্যের সীমা বহুদূরে বিস্তৃত করেন। তিনি একাধারে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য -এর সামরিক ক্ষমতা ও অশোক -এর ধর্মানুরক্তির সমন্বয় করেন।
  • (২) তিনি সোভিয়েত তুর্কীস্থান ও সিংকিয়াং হতে ভারতের সাঁচী এবং পশ্চিমে সিন্ধু দেশ হতে পূর্বে উত্তরপ্রদেশ পর্যন্ত এক বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এর আগে বা পরে আর কোনো ভারতীয় রাজার পক্ষে এরূপ মধ্য এশিয়া সহ বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করা সম্ভব হয়নি।

কুষাণ সাম্রাজ্যের ভারতীয়করণ

  • (১) কণিষ্কের আমলে কুষাণ সাম্রাজ্যের ভারতীয়করণ সম্পূর্ণ হয়। মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত থাকার জন্য এযাবৎ কুষাণ সাম্রাজ্য সম্পূর্ণ ভারতীয় চরিত্র পায়নি। কণিষ্ক তার মধ্য এশিয়া সাম্রাজ্য অক্ষুণ্ণ রেখে তাঁর সাম্রাজ্যকে ভারতীয় চরিত্র দেন।
  • (২) তিনি তাঁর বাসস্থান ও রাজধানী হিসেবে পুরুষপুর বা পেশোয়ার শহরটিকে বেছে নেন। এই স্থান থেকে তাঁর ভারতীয় ও মধ্য এশিয়া সাম্রাজ্যের উপর নজরদারী করার সুবিধা ছিল। পেশোয়ার নগরীকে তিনি সঙ্ঘারাম প্রাসাদ, উদ্যান প্রভৃতির দ্বারা রমনীয় করেন। পেশোয়ারে তিনি সর্বাস্তিবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্যে যে সঙ্ঘারাম তৈরি করেন তা বহু শতাব্দী ধরে লোকের দর্শনীয় স্থান ছিল।
  • (৩) কণিষ্কের শাসনকালে মথুরা, বারাণসী, উজ্জয়িনী, তক্ষশীলা প্রভৃতি নগরীও বিশেষ সমৃদ্ধিশালীনি ছিল। কুষাণ সাম্রাজ্যের সার্বিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দরুন এই নগরীগুলি সমৃদ্ধিশালী হয়।

বাণিজ্যের উন্নতি

  • (১) কণিষ্কের শাসনকালে ভারতীয় অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের খুবই উন্নতি ঘটে। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতে ঘন ঘন বৈদেশিক আক্রমণ ও রাষ্ট্র বিপ্লবের ফলে বাণিজ্যের ক্ষতি হয়েছিল। কণিষ্ক গঙ্গা উপত্যকা থেকে মধ্য এশিয়ার অক্ষু নদের উপত্যকা পর্যন্ত এক সুশৃঙ্খল সুবিন্যস্ত সাম্রাজ্য স্থাপন করে বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি করেন।
  • (২) চীনা রেশম মধ্য এশিয়া হয়ে সিন্ধু বন্দর বারবারিকাম থেকে রোমান সাম্রাজ্যে রপ্তানি হতে থাকে। ভারতীয় মশলা, বিশেষত, লঙ্কা, মরিচ, সুগন্ধি মশলা, চন্দন, হাতির দাতের দ্রব্য, মৃগনাভি, হীরা প্রভৃতি রোমান সাম্রাজ্যে রপ্তানি হত। এর বিনিময়ে রোম থেকে প্রভূত সোনা ভারতে চলে আসত।
  • (৩) কণিষ্কের সাম্রাজ্য ভারতীয় বাণিজ্যকে খোটান এমন কি কাম্পিয়ান হ্রদের তীর পর্যন্ত বিস্তারে সাহায্য করেছিল। কণিষ্কের আমলের স্বর্ণ মুদ্রাগুলি এই যুগের সমৃদ্ধির সাক্ষ্য দিচ্ছে।

বৌদ্ধধর্মের প্রসার

  • (১) কণিষ্কের আমলে বৌদ্ধধর্মের ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে। ডঃ রায়চৌধুরীর মতে, “অশোক হীনযানের জন্য যা করেন, কণিষ্ক মহাযান ধর্মের জন্য তাই করেন।” অশোক অবশ্য বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের পর যুদ্ধনীতি ত্যাগ করেন, কিন্তু কণিষ্ক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করলেও যুদ্ধ নীতি ত্যাগ করেননি।
  • (২) কণিষ্কের মুদ্রা থেকে তার অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতার কথা জানা যায়। কণিষ্ক দেখেন যে, তাঁর আমলে ১৮টি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের সঙ্গে বিরোধের ফলে বৌদ্ধধর্ম হীনবল হয়ে পড়েছিল। তিনি চতুর্থ বৌদ্ধ সঙ্গীতি ডেকে ধর্মীয় তত্ত্বের বিরোধগুলি দূর করে একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে আসার ব্যবস্থা করেন।
  • (৩) নতুন নিয়ম সঙ্কলন করে প্রচার করা হয়। বৌদ্ধ পণ্ডিত পার্শ্ব ও অশ্বঘোষ এই কাজের দায়িত্ব নেন। কণিষ্ক এই নব সংগঠিত ধর্ম বা মহাযান ধর্মকে প্রচারের জন্য বিশেষ উদ্যম দেখান। মধ্য এশিয়ার খোটানে খননের ফলে ভিক্ষুদের আবাস ও সঙ্ঘারাম পাওয়া গেছে। কণিষ্কের প্রভাবে চীন -এ ও পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধধর্মের বিস্তার ঘটে।

সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা

  • (১) কণিষ্ক কেবলমাত্র ধর্মানুরাগী ও বিজেতা ছিলেন না। তিনি শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কণিষ্কের আমলে গান্ধার শিল্প -এর চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। গান্ধার শিল্পে গ্রীক ও ভারতীয় রীতির মিশ্রণে বুদ্ধমূর্তি তৈরি করা হত।
  • (২) গাঙ্গেয় উপত্যকায় মথুরার শিল্পরীতিরও বিকাশ ঘটে। কণিষ্কের কবন্ধ মূর্তি এর পরিচয় দেয়। কুষাণ যুগের স্থাপত্য কণিষ্কের নির্মিত পেশোয়ারের বিখ্যাত বিহার, সুর-মৌচালের বিহারে দেখা গেছে। তক্ষশিলার ধর্মরাজিক বিহারেও কুষাণ যুগের স্থাপত্যের পরিচয় পাওয়া যায়।
  • (৩) কণিষ্কের আমলে বহু স্তূপ নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়। ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে কৃষাণ যুগে গান্ধার শিল্পরীতির পাশাপাশি ব্যাকট্রিয় শিল্পরীতিরও উদ্ভব হয়েছিল। এই শিল্পরীতি গান্ধার রীতি থেকে কিছু পৃথক ছিল। এতে মূর্তির মাথার চুল ছিল কোঁকড়ানো।

সাহিত্যে অবদান

  • (১) কুষাণ যুগে সংস্কৃত সাহিত্যের উন্নতি ঘটে। অশ্বঘোষ সংস্কৃত ভাষায় বুদ্ধচরিত রচনা করেন। অশ্বঘোষের দার্শনিক গ্রন্থ বজ্রসূচিও কণিষ্কের আমলে রচিত। সূত্রালঙ্কার গ্রন্থও কুষাণ যুগে রচিত হয়। সম্ভবত কুমারলাত ছিলেন এর লেখক। কণিষ্কের রাজসভায় সংস্কৃত ভাষার কবি ছিলেন। মাতৃচেত।
  • (২) কণিষ্কের যুগে অপর দার্শনিক পণ্ডিত ছিলেন নাগার্জুন। তিনি ছিলেন মাধ্যমিক তত্ত্বের প্রবর্তক। তিনি প্রজ্ঞা পারমিতা সূত্র শাস্ত্র রচনা করেন। কণিষ্কের রাজসভায় ছিলেন গ্রীক স্থপতি এ্যাজেসিলাস, রাষ্ট্রনীতিবিদ মাথর। কণিষ্কের যুগে শরীরবিদ্যা ও ভেষজ বিজ্ঞানে বিখ্যাত চরক ও শল্যবিদ্যায় বিখ্যাত শুশ্রুত জীবিত ছিলেন।

উপসংহার :- কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক সংস্কৃত ভাষাকে সাহিত্য ও ধর্ম প্রচারের বাহন হিসেবে গ্ৰহণ করেন। কথ্য ভাষা প্রাকৃতকে বাদ দিয়ে সংস্কৃতকে গ্ৰহণ করার মধ্যে কোনো কোনো পন্ডিত কুষাণ যুগের আভিজাত্য ও জনসাধারণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নতা লক্ষ্য করেছেন। তবে সংস্কৃত ভাষায় এই যুগে উত্তম গ্রন্থ রচনা আরম্ভ হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Graphics dm developments north west. Tushar enterprises pen raigad. आ येन इल्ला.