যে শ্রেয় মানুষের আত্মাকে দু:খের পথে দ্বন্দ্বের পথে অভয় দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলে সেই শ্রেয়কে আশ্রয় ক’রেই প্রিয়কে পাবার আকাঙ্ক্ষাটি চিত্রায় ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতাটির মধ্যে সুস্পষ্ট ব্যক্ত হয়েছে। বাঁশির সুরের প্রতি ধিক্কার দিয়েই সে কবিতার আরম্ভ।……মাধুর্যের যে শান্তি, এ কবিতার লক্ষ্য তা নয়।….বিরাট্চিত্তের সঙ্গে মানবচিত্তের এই সংঘাত যে কেবল আরামের, কেবল মাধুর্যের তা নয়। অশেষের দিক্ থেকে যে-আহ্বান এসে পৌঁছয় সে তো বাঁশির ললিত সুরে নয়….এ আহ্বান তো শক্তকেই আহ্বান; কর্মক্ষেত্রেই এর ডাক, রসসম্ভোগের কুঞ্জকাননে নয়।–আমার ধর্ম, প্রবাসী, ১৩২৪ পৌষ, ২৯৪ পৃষ্ঠা, অথবা সবুজপত্র, আশ্বিন-কার্ত্তিক।
মহাজীবনের জন্য মানুষের আত্মায় মাঝে মাঝে যে ক্রন্দন জাগে, তাহারই অসাধারণ প্রকাশ এই কবিতাটি। এই কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের কাব্য-সাধনার ধারায় একটি বিশেষ স্থান অধিকার করিয়া রহিয়াছে। কাব্য-বিলাসিতার নিরবচ্ছিন্ন মাধুর্যময় জীবন কবির ভালো লাগে না, তাঁহার মধ্যে যে অসাধারণ কর্মপ্রেরণা আছে তাহা তাঁহাকে তাগাদা দিয়া সংঘাতের পথে বাহির করিয়া দিতে চায়। কবি প্রথম যৌবনে লিখিয়াছেন–
হেথা এই আকাশের কোণে
টলমল মেঘের মাঝার,
এইখানে বাঁধিয়াছে ঘর
তোর তরে, কবিতা আমার।
সেখানে তিনি তাঁহার কল্পনাসুন্দরীকে লইয়া সুখের আরামের নিশ্চিন্ততার ঘর বাঁধিয়াছিলেন, তাঁহার স্বপ্নবিলাসী মন বাস্তব-জগতের রূঢ়তার সংস্পর্শে আসিতে চাহিত না, কল্পনার জাল বুনিয়া হেলাফেলায় বেলা কাটাইয়া দেওয়াই তাঁহার অন্তরের অত্যন্ত প্রিয় ছিল! কিন্তু সে সুখ তাঁহার সহিল না, দেশের দশা দেখিয়া দরদী কবির বুকে ব্যথা বাজিল, কল্পনার স্বপ্নসৌধ চক্ষের নিমিষে ধূলিসাৎ হইয়া গেল; কবি আকুল স্বরে বলিয়া উঠিলেন–এবার ফিরাও মোরে! তাঁহার কল্পনাকে, তাঁহার মানস-সুন্দরীকে, তাঁহার কবিতা-প্রেয়সীকে সম্বোধন করিয়া কবি বলিতেছেন–ওগো মোহিনী, আমাকে কেবল বাঁশীর ললিত তানে মুগ্ধ করিয়া আর ভুলাইয়া রাখিয়ো না, আমার চারিদিকে মায়ার আবরণ টানিয়া আমাকে আর সংসার হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিয়ো না, আমায় সমস্ত কিছু দেখিতে দাও, সব কিছু বুঝিতে দাও,–আমাকে ফিরিয়া যাইতে দাও বাস্তব-সংসারের দৈনন্দিন কুশ্রীতার মাঝখানে, নিরন্নের আর্তস্বরে চঞ্চল সংসারের মধ্যে; উহাদের ব্যথা আজ আমার বুকে আসিয়া লাগিয়াছে, আমাকে আর জড়াইয়া ধরিয়া রাখিও না, আমায় মুক্তি দাও–আমি আমার এই দৈন্য-কদর্যতাময় প্রতিবেশীদের জীবনের অংশীদার হই। কবি এইরূপে বিলাস ও আরাম ত্যাগ করিয়া সংগ্রামের কর্মের বিদ্রোহের জীবন বরণ করিয়া লইবার আগ্রহ বারংবার বহু কবিতায় প্রাকাশ করিয়াছেন–আহ্বান, শঙ্খ, বর্ষশেষ, নববর্ষ, দীক্ষা ইত্যাদি কবিতা দ্রষ্টব্য। এবং তুলনীয়–
বিশ্ব-সাথে যোগে যেথায় বিহারো
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।
নয়কো বনে, নয় বিজনে,
নয়কো আমার আপন মনে,
সবার যেথায় আপন তুমি হে প্রিয়,
সেথায় আপন আমারও।