দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর বিশ্বের দুই প্রধান শক্তিশালী দেশ পুঁজিবাদী জোটের নেতৃত্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সমাজতান্ত্রিক জোটের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে পারস্পারিক সন্দেহ, অবিশ্বাস, ভীতি প্রদর্শন, রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল তাকেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে ‘ঠাণ্ডা লড়াই’ হিসাবে অভিহিত করা হয়। দীর্ঘ চার দশক ধরে চলা এই স্নায়ু যুদ্ধে ১৯৮০ -এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে স্তিমিত হয়ে পড়ে। নিন্মে ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসানের কারণগুলি তুলে ধরা হল –
দাঁতাত ঃ ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসানের পিছনে দাঁতাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। দাঁতাতের ফলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পরস্পরের কাছে এসেছিল। ফলে বিশ্বের দুই মহা শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের উত্তেজনা প্রশমিত হয় এবং আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে সমগ্র বিশ্ব মুক্তি পায়। এইভাবে ঠাণ্ডা যুদ্ধের তীব্রতা কমতে থাকে।
গর্ভাচভ নীতি ঃ ১৯৮০ -এর দশকের শেষ দিকে সোভিয়েত কমিউনিস্ট দলের শীর্ষ নেতা হিসাবে গর্ভাচভ ক্ষমতায় আসেন এবং এই সময় থেকেই ঠাণ্ডা যুদ্ধ বা ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সমাপ্তি পর্ব শুরু হয়েছিল। তিনি গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রৈকার মাধ্যমে সিভিয়েত ইউনিয়নে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। ফলে অবরুদ্ধ সোভিয়েত ইউনিয়ন উদারবাজার অর্থনীতির পথে চলতে শুরু করে। ফলে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের তীব্রতা কমতে শুরু করে।
দ্বি-মেরুপ্রবণতার সমাপ্তি ঃ ঠাণ্ডা যুদ্ধ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দ্বি-মেরুকরণের জন্ম দিয়েছিল। একদিকে ছিল পুঁজিবাদী মার্কিন জোট এবং অন্যদিকে ছিল সাম্যবাদী সোভিয়েত জোট। অবশেষে একটি বিশেষ অধ্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে এবং বিশ্বে দ্বি-মেরুপ্রবণতার অবসান হয়। যা আন্তর্জাতিক সমাজে ঠাণ্ডাযুদ্ধকে স্তিমিত করে দেয়।
বহুকেন্দ্রীকতার আবির্ভাব ঃ ঠাণ্ডা যুদ্ধ বা ঠাণ্ডা লড়াই চলাকালীন বিশ্বে বহুকেন্দ্রীকতার উদ্ভব ঘটে। এই সময় বিশ্বের দুই সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের অনুগামী রাষ্ট্রের ওপর আধিপত্যের স্থাপনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুকেন্দ্রীকতা সৃষ্টি হয় এবং ঠাণ্ডা যুদ্ধের গুরুত্ব হ্রাস পায়।
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন ঃ দুই সুপার শক্তির মধ্যে চলতে থাকা ঠাণ্ডা লড়াই ও বিশ্ব দ্বি-মেরুকরণের পাল্টা প্রতিক্রিয়া রুপে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের জন্ম হয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি ঠাণ্ডা লড়াইয়ের তীব্র বিরোধিতা করে এবং জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে ফলে ঠাণ্ডা যুদ্ধ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।
প্যারিসের সনদ ঃ ইউরোপীয় রাষ্ট্র সমবায় স্থাপন করার লক্ষ্যে গর্ভাচভের উদ্যোগে ১৯৯০ সালে প্যারিসের সনদ স্বাক্ষরিত হয়। ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসানের জন্য এটিকেও একটি কারণ হিসাবে ধরা যেতে পারে।
সহযোগিতার পরিধির বিস্তার ঃ ঠাণ্ডা যুদ্ধ বা স্নায়ু যুদ্ধের উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে দুই মহাশক্তিধর দেশ মারণাস্ত্র উৎপাদনের খেলায় মেতে উঠেছিল। তবে তারা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে যে, এই খেলা ভবিষ্যতে গোটা পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেবে। এরপর সাতের দশকের শুরু থেকেই এই দুই দেশ অস্ত্রের প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসতে থাকে এবং পারস্পারিক সহযোগিতার পরিধি বিস্তার করার চেষ্টা করে। এইভাবে ধীরে ধীরে পারস্পারিক অবিশ্বাস ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাতাবরণের অবসান ঘটতে থাকে এবং ঠাণ্ডা যুদ্ধের উত্তেজনা স্তিমিত হয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ঠাণ্ডা যুদ্ধের প্রভাব
ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রেক্ষাপট
ঠান্ডা লড়াই -এর পিছনে আদর্শগত বা অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও বেশ কিছু বিষয় তথা আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী কার্যকর ছিল। যেমন –
(১) সাম্যবাদের বিরোধিতা
রাশিয়ায় স্বৈরাচারী জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লব বা রুশ বিপ্লব সংঘটিত হয়। আমেরিকাসহ ধনতান্ত্রিক দেশগুলি এই বিপ্লবের সময়ে রাশিয়ার জারকে সাহায্য করেছিল। পরবর্তী সময়ে এই দেশগুলি সাম্যবাদী সরকারকে উপেক্ষা করে চলতে থাকে। ফলে পশ্চিমি দেশগুলির প্রতি রাশিয়ার মনে বিরূপ ধারণা জন্মায়।
(২) হিটলারের প্রতি তোষণ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ -এর পর জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতায় আসে। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স এই সময় একনায়ক হিটলারের চেয়ে সাম্যবাদী রাশিয়াকে বড় শত্রু বলে মনে করে। ফলে তারা হিটলারকে তোষণ করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে।
(৩) দ্বিতীয় রণাঙ্গণের প্রশ্ন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় (১৯৪১) হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করে। রাশিয়া এই সময় মিত্রশক্তির কাছে দ্বিতীয় রণাঙ্গণ খোলার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মিত্রশক্তি এবিষয়ে অযথা টালবাহানা করতে থাকে। পরে নিজশক্তিতে রাশিয়া যখন হিটলারকে প্রতিহত করে তখন মিত্রশক্তি পশ্চিম ইউরোপে হিটলারের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় রণাঙ্গণ খোলে। এতে মিত্রশক্তির প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ তৈরী হয়।
(৪) ট্রুম্যান নীতি
১৯৪৭ সালে মার্কিন কংগ্রেসের ভাষণে রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান সাম্যবাদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, বিশ্বের যেকোনো স্থানে কোনো মুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, কমিউনিস্ট গোষ্ঠী বা দেশের দ্বারা আক্রান্ত হলে আমেরিকা তাকে সবধরনের সাহায্য করবে। এই ঘোষণার ফলে রাশিয়া তথা সাম্যবাদী দেশগুলির সঙ্গে আমেরিকার দূরত্ব তৈরি হয়।
(৫) রুশ সম্প্রসারণ নীতি
বলশেভিক বিপ্লবের আগে থেকেই রাশিয়া নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে পূর্ব ইউরোপ ও বলকান অঞ্চলে সম্প্রসারণ নীতি গ্রহণ করে। ১৯৪৫ সালে ইয়াল্টা সম্মেলনে রুশ রাষ্ট্রপতি স্ট্যালিন আমেরিকা ও ইংল্যান্ডকে এই নীতি বজায় রাখার কথা জানায়। কিন্তু ট্রুম্যান রাশিয়ার এই নীতি মানতে রাজি ছিলেন না।
(৬) পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে মতভেদ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও চিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে একটি কাউন্সিল গঠিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল অক্ষশক্তিভুক্ত দেশগুলির সঙ্গে কিভাবে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করা হবে তা ঠিক করা। কিন্তু কাউন্সিলের প্রত্যেক অধিবেশনেই রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে অন্যদের তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়।
(৭) জার্মানির ক্ষতিপূরণ
ইয়াল্টা সম্মেলনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী করে জার্মানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আমেরিকা ও ইংল্যান্ড ক্ষতিপূরণ আদায়ে অনীহা দেখায়। রাশিয়ার ধারণা হয় জার্মানিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর জন্যই ক্ষতিপূরণ আদায় করা হচ্ছে না।
(৮) আণবিক বোমার গবেষণা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন রাশিয়াকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে আমেরিকা পরমাণু বোমা বানায়। ফলে আমেরিকার প্রতি রাশিয়ার সন্দেহ বৃদ্ধি পায়। পরে আমেরিকা জাপানে এই বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে রাশিয়া ক্ষুব্ধ হয়।
ঠান্ডা লড়াই
এই সমস্ত ঘটনা পরম্পরায় আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও অবিশ্বাস তৈরি হয়। এই অবিশ্বাস একসময় যুদ্ধের আবহ তৈরি করে যা ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।
ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রভাব
ঠান্ডা লড়াই সমগ্র বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিককে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ওপর এর প্রভাব বেশি পড়েছিল।
(১) সামরিক জোট গঠন
ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকটি সামরিক জোট প্রতিষ্ঠিত হয়।
(২) অস্ত্র প্রতিযোগিতা
ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ‘ন্যাটো’ শিবির এবং সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ‘ওয়ারশ চুক্তি’ শিবির পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নামে। উভয় পক্ষই প্রচুর পরিমাণ পরমাণু অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য মজুত করে রাখে।
(৩) আন্তর্জাতিক বিরোধ
পশ্চিমি জোট ও সমাজতান্ত্রিক জোটের মধ্যে উদ্ভূত ঠাণ্ডা লড়াইয়ের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কয়েকটি সংকট ঘনীভূত হয়। যেমন – কোরিয়া যুদ্ধ (১৯৫০ খ্রি.), ভিয়েতনাম যুদ্ধ (১৯৫৬-৭২ খ্রি.), সুয়েজ সংকট (১৯৫৬ খ্রি.), কিউবা সংবট (১৯৬২ খ্রি.) প্রভৃতি।
(৪) বার্লিন প্রাচীর ধলিসাৎ
ঠান্ডা লড়াইয়ের ফলে বার্লিন প্রাচীর তৈরি হয়েছিল। আবার ঠান্ডা লড়াই-ই ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে এই প্রাচীর ধ্বংসে উদ্যোগ নিয়েছিল।
(৫) সোভিয়েত রাশিয়ার ভাণ্ডন
ঠান্ডা লড়াইয়ে অংশ নিয়ে রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগত অস্ত্রনির্মাণে এবং বিভিন্ন দেশকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে আর্থিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া ভেঙে পড়ে।
(৬) স্বাধীনতা লাভ
ঠান্ডা লড়াই ও তার ফলে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনে কয়েকটি বালটিক রাজ্য এবং পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়ার লাতভিয়া, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া-সহ বেশ কয়েকটি প্রজাতন্ত্র স্বাধীনতা লাভ করে।
(৭) একমেরুকরণ
ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ঘটলে আমেরিকা পৃথিবীর একমাত্র শ্রেষ্ঠ শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ফলে একমেরু বিশ্বব্যবস্থা অর্থাৎ একমেরুকরণ গড়ে ওঠে।
(৮) কমিউনিজমের পতন
রাশিয়ার নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক জোট পশ্চিমি জোটের বিরুদ্ধে যে লড়াই শুরু করেছিল তাতে কমিউনিস্ট জোটের পরাজয় ঘটে। ফলে বহু দেশে ক্রমশ কমিউনিস্ট প্রভাবের অবসান ঘটতে থাকে।
উপসংহার :- নোয়াম চমস্কির মতে ঠান্ডা যুদ্ধ হল এমন একটি কার্যকরী ব্যবস্থা যাতে মহাশক্তিধর দেশগুলি নিজেদের অঞ্চলগুলি নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল ( ‘The cold war is a highly functional system by which the superpowers control their own domains’)I