সংস্কৃতির সংজ্ঞা :-
সমাজতত্ত্বে তথা নৃতত্ত্বে ‘ সংস্কৃতি শব্দটির একটি অন্য ধরনের গুরুত্ব রয়েছে যা প্রকৃতভাবেই ভিন্ন অর্থ বহন করে । ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ইংরেজি ‘ Culture ‘ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হলো ‘ সংস্কৃতি ’ আর ইংরেজি এই ‘ Culture ’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘ Colere থেকে যার অর্থ ‘ কর্ষণ করা ’ । ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী E. B. Tylor 1871 খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে সংস্কৃতির সংজ্ঞাদানে প্রয়াসী হয়েছিলেন । তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ Primitive Culture ‘ এ ‘ সংস্কৃতি ‘ বিষয়ে বিশেষ ব্যাখ্যা প্রদান করেন এবং সংজ্ঞা দেন । তাঁর মতে , ‘ সংস্কৃতি হলো এমন একটি জটিল সামগ্রিক সত্তা যার মধ্যে সামাজিক মানুষের জ্ঞান , বিশ্বাস , শিল্প , নৈতিকতা আইন , রীতিনীতি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কর্মদক্ষতা এবং অভ্যাস বিকশিত হয়ে ওঠে । এদের সামগ্রিক ছন্দোময় পরিস্থিতিই সংশ্লিষ্ট মানবগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে রূপায়িত করে । এই ব্যাখ্যা প্রদানের জন্যই Tylor- কে সংস্কৃতি বিজ্ঞানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বলে মনে করা হয় । পরবর্তীকালে বিভিন্ন নৃবিজ্ঞানী সংস্কৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের সংজ্ঞা প্রদান করেন । আরেকজন বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানী B. Malinowski মানব সংস্কৃতির কর্মপদ্ধতিকে দুইভাগে বিভক্ত করেছেন ।
জীবনের সামগ্রিক জীবনধারাই হলো সংস্কৃতি । এটি হলো সমাজ ও সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের অজস্র বিষয়ের একটি জটিল ও মিশ্র রূপ , যার মধ্যে রয়েছে সমাজের সমষ্টিগত জ্ঞান , নীতিবোধ , বিশ্বাস , আইন , কলা , প্রথা ইত্যাদি এবং সমাজের সদস্য হিসাবে মানুষের যেকোনো বিষয়ে অর্জিত দক্ষতা ও অভ্যাস । এই বিষয়গুলিকে ব্যাখ্যার মাধ্যমে আমরা মানবসমাজের ‘ সংস্কৃতি ’ বিষয়ে কতগুলি বিশেষ লক্ষণ বা চরিত্র খুঁজে পাই ।
সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান সম্পর্কে :-
মানুষ একটি বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক জীব । সংস্কৃতি মানবসমাজে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা সংস্কৃতির বিভিন্ন সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যসমূহ থেকেই উপলব্ধি করা যায় । অতএব সংস্কৃতির উপাদান সম্পর্কে আলোচনা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে থাকে । নিম্নে সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
ক ) মানুষের চাহিদা পূরণে ব্যবহৃত বস্তু :-
পৃথিবীর সকল বস্তুই সংস্কৃতির উপাদান নয় । কেবলমাত্র যে – সমস্ত দ্রব্য মানুষের স্বাভাবিক প্রয়োজন মেটাতে পারে সেই সমস্ত বস্তুই সংস্কৃতির উপাদান । মানুষ সর্বদাই তার বহুমুখী চাহিদা পূরণের তাগিদে বিভিন্ন ব্যবস্থা বা উপায় অবলম্বন করে থাকে । আর এইসব সমাজবিদ্যা 30 উপায় বা ব্যবস্থা সংস্কৃতির অঙ্গীভূত উপাদান হিসাবে পরিগণিত হয় । আবার বস্তুর অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতও সংস্কৃতির উপাদান হিসাবে বিবেচিত হতে পারে । উদাহরণ হিসাবে বলা যায় — গভীর অরণ্যের একটি গাছ মানুষের সংস্কৃতির উপাদান নয় কিন্তু সেই গাছের দ্বারা তৈরি আসবাবপত্র সংস্কৃতির উপাদান ।
খ ) উপাদানের শ্রেণিবিভাগ :-
মানবসমাজের এই সংস্কৃতির দু’টি ভাগে বিভক্ত । যথা—
( I) বস্তুগত বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপাদান ( Material element ) ।
(II) অবস্তুগত বা মানসিক উপাদান ( Non – material or mental element ) ।
( I ) বস্তুগত বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপাদান :-
মানুষ তার বিচারবুদ্ধি , জ্ঞান এবং কর্মকুশলতাকে খাটিয়ে বিবিধ বস্তু উৎপাদন করে । এসব বস্তুর মধ্যে আবার কতকগুলোর উপর পৃথক দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ মূল্যমান বা আদর্শ আরোপিত হয় । এধরনের আদর্শযুক্ত বা মূল্যমানযুক্ত বাহ্যবস্তুকে সংস্কৃতির দ্যোতক বলে অভিহিত করা হয় । যেমন — ঘরবাড়ি , স্কুল , কলেজ , মন্দির , মসজিদ , অফিস – আদালত ইত্যাদি সংস্কৃতির বস্তুগত উপাদানের অন্তর্গত ।
( II) অবস্তুগত বা মানসিক উপাদান :-
মানবসংস্কৃতির যেসব উপাদান কেবলমাত্র উপলব্ধি ও অনুধাবন করা যায় , তাকে সংস্কৃতির অবস্তুগত বা মানসিক উপাদান বলা হয় । এইসব উপাদান সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের আদর্শ , বিশ্বাস , ধ্যানধারণা , আনন্দ , বেদনা , মূল্যবোধ ইত্যাদি মানসিক অনুভূতিকে ইঙ্গিত করে থাকে ।
(গ )উপাদানসমূহের সংশ্লেষ : –
বস্তুগত ও অবস্তুগত উপাদানসমূহের সংমিশ্রণে মানবসংস্কৃতির সৃষ্টি হয় । এই উপাদানগুলি একে অপরের থেকে আলাদা নয় । যেকোনো সমাজের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টিভঙ্গি , আচার – আচরণ , চলাফেরা , কথাবার্তার মধ্যে গভীর সংযোগ ও সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয় ।
(ঘ ) উপাদানসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান :-
যেকোনো সমাজ ব্যবস্থাতে সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান বা ভারসাম্য বজায় রাখার একটি প্রবণতা দেখা যায় । এ ধরনের প্রবণতার জন্য সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর সাথে জীবদেহের তুলনা করা হয় । সংস্কৃতির একটি উপাদানের পরিবর্তন অন্যান্য উপাদানকেও প্রভাবিত করে ।
(ঙ ) সংস্কৃতির প্রলক্ষণ :-
সমাজের ব্যক্তিবর্গের বহুবিধ প্রয়োজন পূরণের তাগিদেই সৃষ্টি হয়েছে সাংস্কৃতিক প্রলক্ষণের । যেমন — রোগ নিরাময়ের প্রয়োজনেই সৃষ্টি হয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞান । এই ধরনের সৃষ্টিমূলক সংস্কৃতিতে সাংস্কৃতিক প্রলক্ষণ বলা হয়ে থাকে ।
(চ ) সংস্কৃতির উপাদানের সৃষ্টি :-
বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক প্রলক্ষণে