শ্রেণীর সংজ্ঞা লেখ। শ্রেণী মনোভাব ও শ্রেণী চেতনার প্রকৃতি আলোচনা কর | Define Class. Explain the nature of class attitude and class consciousness.

শ্রেণীর সংজ্ঞা :-

মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে শ্রেণী হল এক আর্থ-সামাজিক সত্তা। উৎপাদন-উপাদানের সঙ্গে সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তিগত শ্রেণী নির্ধারিত হয়। ব্যক্তির শ্রেণীগত অবস্থান নির্ভর করে সামাজিক উৎপাদন উপাদানের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক এবং সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থার ব্যক্তির অবস্থানের উপর। মার্কসবাদে ব্যক্তির মানসিকতা এবং আয় ও অভ্যাসের তারতম্য শ্রেণীগত পার্থক্যের উৎস বা সামাজিক শ্রেণী নির্ধারণের ক্ষেত্রে মাপকাঠি হিসাবে বিবেচিত হয় না।

মার্কসের মতে শ্রেণী মনোভাব :-

মার্কস-এঙ্গেলস ব্যাপকভাবে ‘শ্রেণী’ কথাটি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কোথাও এর সংজ্ঞা দেন নি। মার্কস দুটো যুযুধান মূল শ্রেণীর কথা বলেছেন। এ দু’টি শ্রেণী হল বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত। সমস্ত উৎপাদিকা শক্তি এবং উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীর বণ্টন বুর্জোয়াদের নিয়ন্ত্রণাধীন। জীবনধারণের জন্য বুর্জোয়াদের কাছে শ্রম বিক্রী করতে প্রলেতারিয়েতরা বাধ্য হয়। প্রধান দুটি শ্রেণী ছাড়া মার্কস সমাজে অন্যান্য শ্রেণীর অস্তিত্বের কথাও বলেছেন। যেমন, পাতি বুর্জোয়া (Petty bourgeoise) ও কৃষক শ্রেণী থাকে। তবে বিপ্লবের ক্ষেত্রে এদের কোন ভূমিকার কথা তিনি উল্লেখ করেননি। তা ছাড়া ক্ষেতমজুর, বুদ্ধিজীবী ও লুম্পেন প্রলেতারিয়েত ( Lumpen Proletariat)-এর কথাও তিনি বলেছেন। মার্কস Class Struggle in France গ্রন্থে চোর, অপরাধী, ভবঘুরে প্রভৃতি ইতর শ্রেণীর লোকদের লুম্পেন প্রলেতারিয়ে হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এরা রীতিমত প্রতিক্রিয়াশীল এবং সমাজের প্রগতিতে এদের কোন ভূমিকা নেই।

মার্কসের মতানুসারে সমাজ গতিশীল। এই গতিশীল সমাজে কোন শ্রেণী চিরদিন একই রকম থাকতে পারে না। শ্রেণী সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণার মধ্যে একটি মনোগত বা পরিবর্তনশীল উপাদান পরিলক্ষিত হয়।

শ্ৰেণী সম্পর্কিত আলোচনা মার্কস ‘Class in itself’ এবং ‘Class for itself’ এই দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। কোন জনগোষ্ঠী নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হতে এবং সুসংগঠিত হতে না পারলে শ্রেণীতে পরিণত হয় না। শ্রেণীতে পরিণত না হলে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম রাজনৈতিক রূপ ধারণ করে না।

লেনিনের মতে শ্রেণী মনোভাব :

মার্কসবাদে শ্রেণীর সংজ্ঞা হিসাবে লেনিনের বক্তব্যকেই গ্রহণ করা হয়। লেনিন তাঁর A Great Beginning গ্রন্থে শ্রেণীর সংজ্ঞা দিয়েছেন। শ্রেণীর সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে লেনিন উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যক্তির ভূমিকার উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতানুসারে শ্রেণী বলতে এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বোঝায়। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য বর্তমান। ঐতিহাসিকভাবে নির্দিষ্ট সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থায় স্বতন্ত্র স্থান অনুসারে এই পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রতিটি গোষ্টীর নিজস্ব স্থান আছে। শ্রেণীর ধারণ উৎপাদন-প্রকৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। তা ছাড়া প্রতিটি উৎপাদন পদ্ধতি একটি করে শ্রেণী সৃষ্টি করে (“Classes are large groups of people differing from each other by the place they occupy in a historically determined system of social production, by their relation…to the means of production, by their role in the social organization of labour, and, consequently, by the dimensions of the share of social wealth of which they dispose and the mode of acquiring it.”)। শ্রেণী সম্পর্কিত লেনিনের সংজ্ঞার কতকগুলি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। (ক) শ্রেণী হল ইতিহাস সৃষ্টি। মানবসমাজের ক্রমবিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। প্রতিটি উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে শ্রেণী অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। (খ) শ্রেণী সামাজিক উৎপাদনে যে ভূমিকার অধিকারী হয় তদনুসারে শ্রেণী বিশিষ্ট হয়ে উঠে। (গ) শ্রেণী উৎপাদন ব্যবস্থার সমেগ সম্পর্কযুক্ত। তাই উৎপাদন-ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটলে, শ্রেণী র কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটে। (ঘ) শ্রেণী উৎপাদনের উপাদনগুলির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু এই সম্পর্ক সকল ক্ষেত্রে সমান নয়। শ্রেণী সম্পর্কিত লেনিনের বক্তব্য প্রধানত পরস্পর-বিরোধী শ্রেণী-বিন্যাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে বিবেচিত হয়। তবে এই সংজ্ঞার সাহায্যে গুণগত পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রেণী-সম্পর্কের পরিবর্তন এবং শ্রেণী-বিলোপের বিষয়টিও ব্যাখ্যা করা সম্ভব।

শ্রেণী মনোভাব :

সর্বকালের এবং সর্বপ্রকারের সমাজব্যবস্থায় জীবনধারণের তাগিদে মানুষকে উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হয়। উৎপাদনের উপকরণ এবং শ্রমের সমন্বয়ে উৎপাদন শক্তির সৃষ্টি হয়। তবে মানুষের পরিশ্রমই হল প্রধান শক্তি। কিন্তু মানুষ একা নয়, সামাজিকভাবে বা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে উৎপাদন করে। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এই যে সম্পর্ক স্থাপিত হয় তাকে উৎপাদন সম্পর্ক বলে। উৎপাদনে উপাদানগুলিকে কেন্দ্র করে এই সম্পর্কের সৃষ্টি। কেউ এই উপাদানসমূহের মালিক, আবার কেউ কায়িক শ্রমের দ্বারাই উৎপাদনে অংশ গ্রহণ করে। যে সমাজব্যবস্থায় উৎপাদদের উপাদানসমূহ সামাজিক মালিকানার পরিবর্তে ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকে সেখানেই শ্রেণীভেদ থাকে। বিভিন্ন ধরনের সমাজব্যবস্থায় (আদিম সাম্যবাদী সমাজ ছাড়া) এই শ্রেণীভেদ বিভিন্ন রূপের হয় যেমন, দাস সমাজে মালিকশ্রেণী ও দাসশ্রেণী, সামন্ত সমাজের সামন্তশ্রেণী ও ভূমিদাস, বুর্জোয়া সমাজে বুর্জোয়া শ্রেণী ও সর্বহারা শ্রেণী ইত্যাদি। উৎপাদন সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে অবস্থান অনুসারে শ্রেণীবিন্যাস নির্দিষ্ট হয়। অন্যভাবে বলতে গেলে উৎপাদন উপাদানের সঙ্গে সম্পর্কের মাপকাঠিতে শ্রেণীর পার্থক্য নির্ধারিত হয়। উৎপাদন-উপাদানসমূহকে কেন্দ্র করে উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিতে শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। লেনিন বলেছেন: ‘The fundamental feature that distinguishes classes is the place they occupy in social production and consequently the relation in which they stand to the means of production.” এইজন্য একশ্রেণীভুক্ত সকলের কতকগুলি অভিন্ন শ্রেণী স্বার্থ থাকে। তাই এমিল বার্নস বলেছেন, “একই প্রণালীতে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে সমাজের এইরকম এক-একটি অংশ হল এক-একটি শ্রেণী।” লেনিন বলেছেন: “শ্রেণীগুলি হল এমন কতকগুলি বৃহৎ জনসমষ্টি যাদের পরস্পরের মধ্যে বিভিন্নতা নির্ভর করে ঐতিহাসিক ধারায় নির্ধারিত একটি সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থায় তাদের স্থান অনুযায়ী, উৎপাদনের উপায়সমূহের সঙ্গে তাদের সম্প অনুযায়ী, শ্রমের সামাজিক সংগঠনে তাদের ভূমিকা অনুযায়ী, এবং এর ফলস্বরূপ সমাজের যে সম্পদ তারা সৃষ্টি করে তার অংশের মাত্রা এবং সেই অংশ অর্জনের পদ্ধতির দ্বারা।”

শ্রেণী চেতনার প্রকৃতি :

মার্কসবাদীরা ‘শ্রেণী’র ধারণাটির দুটি দিকের কথা বলেন। এই দুটি দিক হল: বিষয়গত (objective) এবং বিষয়ীগত (subjective)। সামাজিক শ্রেণী বলতে যখন ব্যক্তির উৎপাদন কাঠামোগত অবস্থা বোঝান হয় তখন তা হল শ্রেণীর বিষয়গত ধারণা। যখন ব্যক্তির মানসিক বা আদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে তার শ্রেণীর কথা বলা হয় তখন তা হল শ্রেণীর বিষয়ীগত ধারণা। বিষয়গত বিচারে কোন বিশেষ ব্যক্তি শোষিত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত বলে মনে হতে পারে। কিন্তু মানসিক বা আদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, শাসক-শোষক শ্রেণীর সমর্থক হতে পারে। প্রকৃত প্রস্তাবে, শোষক ও শোষিত শ্রেণীর মধ্যে শ্রেণী-সংগ্রামের প্রাক্কালে কোন ব্যক্তির আচার-আচরণ অনুসারে সেই ব্যক্তির শ্রেণী চরিত্র জানা যায়। তাই বলা হয় যে, শ্রেণীর উদ্ভব ও বিকাশ শ্রেণী-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ঘটে থাকে। ফিসার (Fischer) বলেছেন: “A class is born in class-struggle.”

দাস-সমাজেই শ্রেণীভেদ দেখা দেয়: আদিম সাম্যবাদী সমাজে শ্রেণীভেদ ছিল না। কারণ সেই যুগে মানুষের মধ্যে আর্থনীতিক সামর্থ্যের পার্থক্য এবং তার ফলে আর্থনীতিক স্বার্থের সংঘাত ছিল না। দাস সমাজেই সর্বপ্রথম আর্থনীতিক স্বার্থ ও সামর্থ্যের পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে পরস্পর-বিরোধী দুটি শ্রেণীর উদ্ভব হয়। দাসসমাজে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্রমবিভাগের সৃষ্টি হয়। তার ফলে এক শ্রেণীর মানুষকে (এরাই সংখ্যায় গরিষ্ঠ) কায়িক শ্রমে নিযুক্ত হতে হল: এরা হল দাসশ্রেণী। আর অল্পসংখ্যক কিছু ব্যক্তি পরশ্রমভোগী শ্রেণীতে পরিণত হল; এরা হল দাস-মালিক শ্রেণী। প্রতিটি শ্রেণীবিভক্ত সমাজে পরস্পর বিরোধী দুটি মুখ্য শ্রেণী ছাড়াও কতকগুলি গৌণ শ্রেণী থাকে। দাস-সমাজে দাস-মালিক ও দাস-শ্রেণী এই দুটি মুখ্য শ্রেণী ছাড়াও কারিগর, স্বাধীন কৃষক প্রভৃতি অন্যান্য গৌণ শ্রেণীও ছিল। আবার এমিল বার্নস-এর ভাষায়, “অনুন্নত দেশগুলিতে এখনও উদীয়মান পুঁজিপতি শ্রেণী এবং উদীয়মান শ্রমিক শ্রেণী পাশাপাশি ভূস্বামী এবং প্রায় ভূমিদাসের অনুরূপ কৃষকদের দেখতে পাওয়া যায়।

বিরুদ্ধবাদী সমাজতত্ত্ববিদদের অভিমত: শ্রেণী সম্পর্কিত মার্কসবাদী বক্তব্যের বিরোধিতাও পরিলক্ষিত হয়। সমাজতত্ত্ববিদদের মধ্যে যাঁরা মার্কসবাদ-বিরোধী তাঁরা শ্রেণীসংক্রান্ত মার্কসীয় ধারণাকে স্বীকার করেন না। এ প্রসঙ্গে সরোকিন, ড্যানিয়েল বেল প্রমুখ মনীষীদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই শ্রেণীর সমাজতত্ত্ববিদ্‌গণ শ্রেণীকেন্দ্রিক বিশ্লেষণধারায় বিশ্বাস করে না। তাঁরা সামাজিক স্তরবিন্যাস ও সামাজিক সচলতার কথা বলে থাকেন। বিরুদ্ধবাদী সমাজতত্ত্ববিদদের অভিমত অনুসারে বর্তমান শতাব্দীতে বৈষয়িক বিচারে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশগুলিতে নির্দিষ্ট কোন শ্রমিক শ্রেণীর অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয় না। এই শ্রেণী চিন্তাবিদ্রা সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রেণীর ধারণাটি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার পক্ষপাতী। সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা হিসাবেই তারা শ্রেণীর কথা বলেন। তাছাড়া মর্যাদাভিত্তিক গোষ্ঠী হিসাবেও তাঁরা শ্রেণীর ধারণাকে ব্যাখ্যা করেন। এ ছাড়া বিরুদ্ধবাদীদের আরও অভিযোগ হল যে মার্কসবাদে যথাযথভাবে আর্থসামাজিক শ্রেণীর তাত্ত্বিক দিকটি সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন করা হয়নি।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Why national building regulations. Smita jewellers pen. Bespoke kitchens dm developments north west.