শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করো | Mention the scope of Educational Psychology.

শিক্ষা মনােবিজ্ঞানের প্রকৃতি

শিক্ষা মনােবিজ্ঞান হল সাধারণ মনােবিজ্ঞানের একটি শাখা। শিক্ষা বলতে আমরা ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের জন্য কল্যাণ কর আচরণ গুলি আয়ত্ত করাকে বুঝি। আর মনােবিজ্ঞান হল আচরণ সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান। মনােবিজ্ঞানের কাজ হল মনের বিভিন্ন আচরণ, প্রকৃতি আলােচনা করা। শিক্ষাদান প্রক্রিয়াটিকে আরও সহজ, সরল করার জন্য এবং শিক্ষা দানের সময় যে সমস্ত সমস্যার উদ্ভব হয় সেগুলির সমাধানের জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে মনােবিজ্ঞানের নীতি গুলি প্ৰযােগ করা হয়। এইভাবে শিক্ষা মনােবিজ্ঞানের সৃষ্টি হয়েছে। ব্যক্তির জন্ম থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত যে বিকাশ ঘটে এই বিকাশের বিভিন্ন পর্যায় গুলির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় ব্যক্তির মধ্যে বিকাশের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটে তা বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করে শিক্ষা মনােবিজ্ঞান। তাই বলা যায় শিক্ষা মনোবিজ্ঞান হল মনােবিজ্ঞানের এমন একটি প্রয়োগমূলক দিক যেখানে শিক্ষাসংক্রান্ত আচরণ নিয়ে বিশ্লেষণ করে এবং আচরণকে আরাে কিভাবে উন্নত করা যায় সেই বিষয়ে আলােচনা করে।

তাই বলা যায় শিক্ষা মনােবিজ্ঞান মনােবিজ্ঞানের একটি শাখা হলেও বর্তমানে শিক্ষা মনােবিজ্ঞান কে একটি আলাদা বিষয় রূপে পরিগণিত করা হয়েছে। শিক্ষা মনােবিজ্ঞানের প্রকৃতি গুলি হল – 

শিক্ষা মনােবিজ্ঞান বিজ্ঞানের একটি পৃথক বিষয় : শিক্ষা মনােবিজ্ঞান মনােবিজ্ঞানের একটি প্রয়োগমূলক শাখা বলে বিবেচিত হলেও বর্তমানে শিক্ষা মনােবিজ্ঞান একটি পৃথক বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃত। কোন বিষয়কে পৃথক বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হলে তাকে কতগুলি শর্ত পালন করতে হয়। বিষয়টিকে যথেষ্ট বিস্তৃত হতে হবে, তার নিজস্ব অনুশীলন পদ্ধতি ও সমস্যা থাকবে যার ওপর ভিত্তি করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সমস্যা সমাধানের উপায় নির্দিষ্ট করা যাবে। বিষয়টিকে আরও সমৃদ্ধ করা যাবে। শিক্ষা মনােবিজ্ঞান এই সমস্ত শর্ত গুলি পূরণ করে। তাই শিক্ষা মনােবিজ্ঞান একটি পৃথক বিষয় হিসাবে স্বীকৃত।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়ােগ : শিক্ষা মনােবিজ্ঞান তার বিষয়গুলি অনুশীলনের জন্য দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করে। ব্যক্তিনির্ভর পদ্ধতি ও নৈর্ব্যক্তিক পদ্ধতি। ব্যক্তিনির্ভর পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম হল – পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি, কেস স্টাডি পদ্ধতি, তুলনামূলক পদ্ধতি, অন্তর্দর্শন পদ্ধতি ইত্যাদি। নৈর্ব্যক্তিক পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম হল – পরীক্ষণ পদ্ধতি, জেনেটিক পদ্ধতি, পরিসংখ্যান পদ্ধতি, সার্ভে পদ্ধতি ইত্যাদি।

গতিশীলতা :শিক্ষামনােবিজ্ঞান তার আলােচ্য বিষয় গুলির উপর গবেষণার ফলে শিক্ষার নতুন নতুন দিকের উন্মােচন ঘটছে ও পুরনাে ধারণা গুলির পরিবর্তন ঘটছে। যার ফলে নতুন তথ্য, নীতি ও সূত্র আবিষ্কার হচ্ছে যা শিক্ষাবিজ্ঞানকে আরও উন্নত ও কার্যকারী করে তুলেছে। তাই বলা হয় শিক্ষা মনােবিজ্ঞানের প্রকৃতি গতিশীল।

স্বতন্ত্র পরীক্ষামূলক দিক : শিক্ষামনােবিজ্ঞান শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, শিখন সঞ্চালন ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক চিন্তা করতে সহায়তা করে। সেই সঙ্গে শিক্ষককে শিক্ষাদানের কৌশল, শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন, শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থার বিচার, শ্রেণিকক্ষে তৈরি হওয়া বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধান প্রভৃতি বিষয়ে মনােবৈজ্ঞানিক ধারণা সরবরাহ করে। 

আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান : শিক্ষামনােবিজ্ঞান ব্যক্তি ও সমাজের ভালাে হয় এমন বিষয় নিয়ে আলােচনা করে ব্যক্তি ও সমাজের ক্ষেত্রে কোন ক্ষতিকর বিষয় নিয়ে শিক্ষা মনােবিজ্ঞান আলােচনা করেনা। 

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র : শিক্ষা-মনােবিজ্ঞান ব্যক্তিগত পার্থক্যকে গুরুত্ব দেয়। ব্যক্তিগত পার্থক্য একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। ব্যক্তিগত পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে শিক্ষা মনােবিজ্ঞান তার বিষয়ে গুলিকে পর্যালােচনা করে।

)শিক্ষা মনােবিজ্ঞান ও অন্যান্য বিজ্ঞান : শিক্ষা মনােবিজ্ঞান শিক্ষা ও মনােবিজ্ঞান এই দুই বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় | সমাজবিদ্যা, জীববিদ্যা, শারীরবিদ্যা, পরিসংখ্যান, প্রযুক্তিবিদ্যা, কম্পিউটার বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ক তথ্য ও তত্ব শিক্ষা মনােবিদগন ব্যবহার করে শিক্ষা মনােবিজ্ঞানকে আরাে উন্নত ও কার্যকর করে তুলেছে। 

শিক্ষার্থীর আচরণ সংশােধন : শিক্ষা মনােবিজ্ঞানের অন্যতম কাজ হল শিক্ষার্থীদের মধ্যে যদি কোন অপসংগতিমূলক ও অপরাধমূলক আচরণ লক্ষ্য করা যায় তার পরিবর্তন ঘটানাে। শিক্ষা মনােবিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের এই ধরনের আচরণের কারণ অনুসন্ধান করে এবং তার প্রতিকারের জন্য শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়ে থাকে। শিখন কার্যকে আরাে বেশি কার্যকরী করে তােলার জন্য শিক্ষার্থীদের আচরণের পরিবর্তন ঘটায়।

শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের পরিধি বা বিষয়বস্তু

শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের পরিধি বলতে বােঝায় শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বিষয়বস্তুর পরিসরকে। শিক্ষা মনোবিজ্ঞান মূলত শিখন ও শিক্ষণ নিয়ে আলােচনা করে। শিক্ষার্থীর শিক্ষামূলক চাহিদার পরিতৃপ্তি ঘটানাে ও তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানাে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের লক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা হয়। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের পরিধি বা বিষয়বস্তু গুলি হল-

শিক্ষার্থীর কর্মধারা : শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের কর্মধারাই হল শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের প্রাথমিক উপাদান। এর উপর ভিত্তি করে শিক্ষা পরিকল্পনা করা হয়। যেমন- শিক্ষার্থীর চাহিদা, প্রবৃত্তি, প্রক্ষোভ, বুদ্ধি, সৃজনশীলতা ইত্যাদি যা শিক্ষা ও শিখনে বিশেষভাবে প্রযােজনীয়। এ সম্পর্কে আলােচনা করা শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের কাজ। 

শিখন প্রক্রিয়া : শিখন সম্পর্কে সমস্ত তত্ব শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শিখন প্রক্রিয়ার প্রকৃতি, শিখনের নিয়মাবলী, শিখনের সঠিক মূল্যায়ন পদ্ধতি, এছাড়াও নানা ধরনের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে শিক্ষা মনোবিজ্ঞান সাহায্য করে।

জীবন বিকাশের ধারা অনুশীলন : শিশুদের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের দৈহিক, মানসিক, সামাজিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সেগুলিকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে অনুশীলন করা অর্থাৎ শিক্ষার্থীর জীবন বিকাশের ধারা সম্পর্কে আলােচনা করা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বিকাশের জন্য কি কি করনীয় ইত্যাদি শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর অন্তর্গত। 

অভিযােজন প্রক্রিয়া : শিক্ষার্থীদের আচরণ বিশ্লেষণ করা, তাদের সমাজের সঙ্গে সার্থক অভিযােজনের উপযােগী করে তােলা এবং প্রতিকূল পরিবেশকে কিভাবে শিক্ষার্থীরা প্রতিরােধ করবে, তা স্থির করা শিক্ষাশ্রয়ী মনোবিজ্ঞানের আলােচ্য বিষয়। 

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র : শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হল ব্যক্তিগত পার্থক্য বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র। প্রত্যেকটা ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, এটি একটি স্বাভাবিক নিয়ম। ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রের জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আচরণগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তিগত পার্থক্যের প্রকৃতি কি, এই ব্যক্তিগত পার্থক্যকে ভিত্তি করে শিক্ষা পরিকল্পনার রচনা করা শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের কাজ। ব্যক্তিগত বৈষম্য কে ভিত্তি করে ব্যক্তির বিকাশ ঘটানাে গণতান্ত্রিক শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য।

নির্দেশনা ও পরামর্শদান : শিক্ষাক্ষেত্রে জ্ঞানমূলক ও বৃত্তিমূলক নির্দেশদান সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সাহায্য করা। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা পরিকল্পনা রচনা করা। শিক্ষা সংক্রান্ত নানা তথ্য পরিবেশন করা, শিক্ষার সমস্যা সমাধানে সাহায্য করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে একঘেয়েমি দূর করা ইত্যাদি শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের আলােচিত বিষয়বস্তু। 

পরীক্ষা ও মূল্যায়ন : শিক্ষাক্ষেত্রে পরীক্ষা ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিক্ষার্থী কী শিখল, কতটুকু শিখল, তার মধ্যে আচরণের পরিবর্তন ঘটেছে কিনা, যদি না ঘটে তার কারণ কি? কিভাবে তা সংশােধন করা যায় এসব শিক্ষা মনােবিজ্ঞানের আলােচ্য বিষয়। আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানে মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থী কতটা জ্ঞান অর্জন করেছে কেবলমাত্র তা পরিমাপ করা হয়না শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশ ঘটেছে কিনা তার মূল্যায়ন করা হয়।

বাশিবিজ্ঞান : শিক্ষা মনোবিজ্ঞানে শিক্ষামূলক পরিসংখ্যানকে অর্থাৎ রাশিবিজ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কারণ রাশিবিজ্ঞান ছাড়া শিক্ষার্থীদের অগ্রগতির সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। রাশিবিজ্ঞান এর সাহায্যে শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে পরিবেশন করা যায় এবং বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব। এছাড়া শিক্ষার্থীদের অগ্রগতির মূল্যায়ন একমাত্র রাশিবিজ্ঞান দ্বারাই সম্ভব। সেই কারণে আধুনিক শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর তালিকায় রাশিবিজ্ঞানকে স্থান দেওয়া হয়েছে।

শ্রেণীকক্ষ পরিচালনা : শ্রেণিকক্ষ পরিচালনার ক্ষেত্রে একজন শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিভাবে একটা শ্রেণিকক্ষ সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায়, শিক্ষার্থীর আচরণ নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা রক্ষা, তাদের সঠিক শিক্ষাদানের দায়িত্ব শিক্ষকের। এ সম্পর্কে একজন শিক্ষকের যথাযথ জ্ঞান থাকা প্রযােজন। তা নাহলে শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। সেজন্য শ্রেণীকক্ষ পরিচালনার ক্ষেত্রে শিক্ষামনোবিজ্ঞানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

মানসিক স্বাস্থ্য : শিক্ষাব্যবস্থা সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজন। তা নাহলে শিখন-শিক্ষণ প্রক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন হবেনা। শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে নানা ধরনের অপরাধমূলক আচরণ করে থাকে। এগুলি কেন করছে, কিভাবে তা দূর করা যায় এ সমস্ত শিক্ষামনোবিজ্ঞানে আলােচিত হয়।


মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

National building regulations (sa). My invoices explore your city. Graphics dm developments north west.