‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধগ্রন্থ অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথের মানবতাবোধের পরিচয় দিন।

‘মানুষের ধর্ম’ বইতে রবীন্দ্রনাথ মানুষের ভিতর দুরকম ধর্মের অস্তিত্বের কথা বলেছেন। প্রথমটি নিতান্ত প্রাকৃতিক তথা জৈব ধর্ম, যে-ধর্মে শারীরিক প্রয়োজনই সব। মানুষের পূর্বপুরুষ অতীতকালে চার হাত-পায়ে চলাফেরা করেছে। উবু হয়ে চলবার কালে তাদের দৃষ্টি কেবল নিচের দিকেই নিবদ্ধ থেকেছে। তার পরে এক সময়ে মানুষ যখন চলাফেরার কাজ থেকে হাত দুটো মুক্ত করে উঠে দাঁড়াতে পেরেছে, তখন তার দৃষ্টিসীমা গেছে বেড়ে। দূরকে সে প্রত্যক্ষ করেছে। আর মুক্ত হাত দুটিকে অন্য নানা কাজে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়েছে। শারীরিক প্রয়োজন ছাড়ানো নানা সূক্ষ্ম কাজে হাতের ব্যবহার শুরু হয়েছে এইভাবে। আদিগন্ত প্রসারিত দৃশ্য আর বিনা প্রয়োজনের কাজ মানুষকে সৌন্দর্যবোধে দীক্ষা দিয়েছিল। জীবসত্তাকে ছাড়িয়ে গিয়ে মানসধর্মের জাগরণ হওয়ার ফলে প্রাণীজগতের স্বভাবধর্ম থেকে মানুষের ধর্মে উত্তরণ ঘটে মানবজাতির। এই তার দ্বিতীয় ধর্ম।

মানুষকে রবীন্দ্রনাথ চিরযাত্রী বলেছেন। মনুষ্যত্বের সারসত্তার দিকে তার নিয়ত অভিযাত্রা। যে-যাত্রার কথা রয়েছে এলিয়টের ‘দি জার্নি অব দি ম্যাজাই’ কবিতায়। পূর্বদেশীয় বৃদ্ধরা দীর্ঘ যাত্রার অন্তে তীর্থে পৌঁছে বলেছিল, ‘মাতা দ্বার খোলো’। শিশু যিশুখ্রিষ্টের মতো মহামানব তথা শাশ্বত মানবের আবির্ভাব ঘটে তখন। ‘শিশুতীর্থে’র যাত্রীরাও ভয়াবহ ওঠাপড়া বাদবিসংবাদের ভিতর দিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ওই চিরমানবতার তীর্থে উপনীত হয়েছিল। ‘সভ্যতার সংকটে’র যন্ত্রণাদীর্ণ কবিও শেষ পর্যন্ত গেয়ে উঠেছেন—‘ওই মহামানব আসে।/দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে’। চিরন্তন মানুষ হওয়ার জন্যই যাত্রা সর্বমানবের।

দেশে দেশে কালে কালে মানুষ তার সাধনা দিয়ে এক অখণ্ড মানবসত্তা গড়ে তোলে। সেই সত্তা তাকে আপন আত্মা অর্থাৎ আত্মস্বরূপের উপলব্ধিতে পৌঁছে দেয়। সকল মানুষের মিলিত সাধনাতেই অন্তর্নিহিত সত্যের সন্ধান পাই আমরা। তা থেকে মানবমূল্যবোধ তৈরি হয়ে সভ্যতার ভিত্তি পত্তন করে।

রবীন্দ্রনাথ তুলনা করে দেখিয়েছেন—মানবদেহে যেমন অসংখ্য জীবকোষের অবস্থান এবং সেগুলি স্বতন্ত্র থেকেও দেহের সার্বিক পরিপোষণে নিয়োজিত থাকে, তেমনি স্বতন্ত্র ব্যক্তি মানুষই সমন্বিতভাবে মানবসত্তা গড়ে তোলে। সেই পূর্ণের অনুভব ব্যক্তি মানুষের উপলব্ধিতে থাকে। তাই মানুষ জানতে পারে সে ব্যক্তিমাত্র নয়, বিশ্বমানবের অন্তর্গত সত্তা। এতে জাগতিক কোনো সুবিধা নেই, কিন্তু বিরাট সত্তার সঙ্গে একাত্মতার বোধ থেকে জন্মায় অহেতুক আনন্দ। এ সবই মনুষ্যত্বধর্মের পরিচয় বহন করে।

শিল্পসাধনার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান আর কর্মের সাধনা মানুষের জগৎকে ক্রমপ্রসারিত করে। সকল সাধনার ফসল মানবসম্পদ হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মকে সমৃদ্ধ করে। বর্তমানের মানুষ যেমন পূর্বপুরুষের মানসসম্পদের উত্তরাধিকারী হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিসত্তাকে অহং আর ব্যক্তির ভিতরের অর্থাৎ অন্তর্গত সত্তাকে বলেছেন আত্মা। তুলনা দিয়েছেন, ব্যক্তিসত্তাকে যদি বলি প্রদীপ, তো আত্মা হচ্ছে তার শিখা। অন্তর্গত সত্তার কথা রবীন্দ্রনাথের কবিতায়-গানে ফিরে ফিরে এসেছে। গানের দৃষ্টান্ত দিই, যেখানে অন্তর্বাসী সত্তাকে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন কবি—

‘মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে

একেলা রয়েছ নীরব শয়ন-’পরে—

প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো।।’

অন্তর-সম্পদই মানুষকে মহৎ করে। আর অন্ধ ধর্মাচরণে ব্যক্তি হয়ে পড়ে অহংপ্রবণ, যেমন আমরা দেখেছি কাব্যনাট্য ‘বিসর্জনে’ রঘুপতির আচরণে। অপরপক্ষে জয়সিংহ মানবিক বিশ্বাসে স্থির থেকে প্রাণ দিয়ে প্রেমের ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করে। তখন রক্তপায়ী দেবী মূর্তিকে পরিহার করে মহৎ মানব-আত্মাকেই পুষ্পার্ঘ্য দেন কবি। ঘোষণা করেন, প্রেমধর্ম দীক্ষিত মানুষই আকাঙ্ক্ষিত মনুষ্যত্বের ধারক।

‘পত্রপূট’ কাব্যের পনেরো নম্বর কবিতাতে মানবধর্মে বিশ্বাসী পরিণতবয়সী রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য তুলে ধরছি।—‘শুনেছি যাঁর নাম মুখে মুখে,/পড়েছি যাঁর কথা নানা ভাষায় নানা শাস্ত্রে,/কল্পনা করেছি তাঁকেই বুঝি মানি।/তিনিই আমার বরণীয় প্রমাণ করব বলে/পূজার প্রয়াস করেছি নিরন্তর।/আজ দেখেছি প্রমাণ হয়নি আমার জীবনে।/…মন্দিরের রুদ্ধদ্বারে এসে আমার পূজা/বেরিয়ে চলে গেল দিগন্তের দিকে-/সকল বেড়ার বাইরে,/নক্ষত্রখচিত আকাশতলে,/পুষ্পখচিত বনস্থলীতে,/…’। তারপর শেষ কথা—‘আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন/সকল মন্দিরের বাহিরে/আমার পূজা আজ সমাপ্ত হল/দেবলোক থেকে মানবলোকে/আকাশে জ্যোতির্ময় পুরুষে/আর মনের মানুষে আমার অন্তরতম আনন্দে।’

প্রবন্ধের চেয়ে সাহিত্যে মানুষের ধর্মে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসের ছাপ গভীরতর। ‘শিশুতীর্থ’ কবিতাতেও মনুষ্যত্বের জয় ঘোষণা রয়েছে। কষ্টসাধ্য দীর্ঘ মানবযাত্রায় অসহিষ্ণু মানুষ ক্রোধবশে বিশ্বাসী তীর্থযাত্রীকে হনন করে বসে। মানবতাবোধে অবিশ্বাসী হয়ে চীৎকার করে ‘পশুশক্তিই আদ্যাশক্তি’। সকাল বেলার আলোতে নিজেদের কীর্তি দেখতে পেয়ে শিউরে ওঠে নিজেরাই। ধর্মপ্রাণ পথপ্রদর্শকের দেখানো পথেই যাত্রা করে আবার। মহামানবের জন্মতীর্থে পৌঁছে ধ্বনি দেয়-‘জয় হোক মানুষের, ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের’।

সমসাময়িক কালের যাত্রায় আজ আমরাও পৌঁছেছি অসহিষ্ণু হানাহানির পরিস্থিতিতে। হত্যা এখন তুচ্ছ বিষয়। তথাকথিত ধর্মের নামে হত্যা, স্বার্থ উদ্ধারে হত্যা, এমনকী অকারণ আনন্দের জন্যেও হত্যা! জৈব প্রবৃত্তি হয়ে উঠেছে প্রধান। পশুশক্তিই হয়েছে আদ্যাশক্তি! মানুষের ধর্মের সঙ্গে এই পরিস্থিতি সাংঘর্ষিক। আচারসর্বস্ব ধর্মতন্ত্র প্রবল হয়ে ধর্মকে কোণঠাসা করে ফেলছে ক্রমে। ‘কালান্তর’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ধর্ম আর ধর্মতন্ত্রের বৈপরীত্য নির্দেশ করেছেন বিস্তৃত ভাষ্যে। তার সামান্য অংশ উদ্ধার করি—‘ধর্ম বলে, মানুষকে যদি শ্রদ্ধা না কর তবে অপমানিত ও অপমানকারী কারও কল্যাণ হয় না। কিন্তু ধর্মতন্ত্র বলে, মানুষকে নির্দয়ভাবে অশ্রদ্ধা করিবার বিস্তারিত নিয়মাবলী যদি নিখুঁত করিয়া না মান তবে ধর্মভ্রষ্ট হইবে।…ধর্ম বলে, অনুশোচনা ও কল্যাণ কর্মের দ্বারা অন্তরে বাহিরে পাপের শোধন। কিন্তু ধর্মতন্ত্র বলে, গ্রহণের দিনে বিশেষ জলে ডুব দিলে, কেবল নিজের নয়, চোদ্দপুরুষের পাপ উদ্ধার।’

ধর্মতন্ত্রীরা প্রবল হয়ে উঠে ধর্মকে দলিত করছে আজ। হিংসার অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিশ্বের সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে তারা ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নেমেছে। সমগ্র বিশ্ব আজ সংকট-জর্জরিত। মানুষকে আজ মানসসম্পদে ঋদ্ধ হতে হবে। বাংলার কি-নাগরিক কি-লোকসাহিত্যে মহৎপ্রাণ কবিরা যে সব কথা বলে গেছেন, আজ তা স্মরণ করতে হবে। আস্থা রাখতে হবে তার ওপর। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য। তাহার উপরে নাই’—চণ্ডীদাসের এই বাণী থেকে শক্তি সঞ্চয় করা জরুরি। লালন-ও গেয়েছেন—‘সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার, মানুষগুরু নিষ্ঠা যার’। নজরুল আবার ধর্মের চেয়েও বড়ো করে দেখেছেন মানুষকে, বলেছেন—‘মানুষ এনেছে ধর্ম, ধর্ম আনেনি মানুষ কোনো’।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Why national building regulations. Burhani traders pen raigad. Blog dm developments north west.