পণপ্রথা বিরোধী গল্প হিসাবে রবীন্দ্রনাথের ‘দেনাপাওনা’ গল্পটির সার্থকতা বিচার করো। অথবা   রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেনাপাওনা ছোটগল্পের সার্থকতা বিচার করো।

রবীন্দ্রনাথের সমাজ সমস্যা মূলক একটি সার্থক ছোটগল্প দেনাপাওনা। পণপ্রথা আমাদের সমাজের একটি নিদারুণ অভিশাপ। সমাজের সবচেয়ে কোমল যে অংশ স্নেহ ভালবাসায় ভরা, নবজীবন ও যৌবনের স্বপ্নে বিভোর যে তরুনীর মন, তাকে এই নিষ্ঠুর প্রথার যূপকাষ্ঠে আত্মবলিদান দিতে হয়। বিবাহ দুটি তরুন-তরুনীর হৃদয়ের মিলন এবং একই সঙ্গে দুটি পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক। কিন্তু পণপ্রথা এই শুভ সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ নষ্ট করে দেয়। শেষ পর্যন্ত নববধূকে ঠেলে দেয় মৃত্যুর অতল গহবরে। ভালোবাসার হৃদয় বিনিময় টাকাকড়ির দেনাপাওনা এ পরিণত হয়! সভ্য, শিক্ষিত, বিত্তবান বাড়ির অভিভাবকরাও এই কুপ্রথার বশবর্তি হয়ে নববধূর সঙ্গে যে কি নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে, রবীন্দ্রনাথ গল্পটিতে তার বাস্তব ছবি এঁকেছেন। এমন পরিস্থিতিতে স্নেহ ভালবাসার মানবিক দাবিকে উপেক্ষা করে অর্থবিত্তের দানবিক দাবি বড় হয়ে ওঠে। একান্ত আপনজনকে মর্মান্তিক আঘাত দিতে সে দ্বিধা বোধ করে না। এমনি একটি ট্রাজিক রসের গল্প দেনা পাওনা।

গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র নিরুপমা বাবা মায়ের নয়নমনি। পাঁচ ছেলের পর এই মেয়েকে পেয়ে রামসুন্দরের আনন্দের শেষ ছিল না। স্নেহে যত্নে একে বড় করেছে রামসুন্দর। বিবাহযোগ্যা হলে নিরুপমার যোগ্য পাত্র মিললো। পাত্রের পিতা রায় বাহাদুর এর সঙ্গে রামসুন্দরের পাকা কথা হল 10000 টাকা পণ। বিষয়ে বুদ্ধিহীন আবেগপ্রবণ রামসুন্দর রাজি হয়ে গেল। কিন্তু টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে সে বিপাকে পড়ল। চড়া সুদে যে ধার দিতে রাজি হয়েছিল, বিয়ের দিন সে পিছিয়ে গেল। পণ নিয়ে বিয়ের আসরে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলো। নগদ টাকা হাতে না পেয়ে রায় বাহাদুর বেঁকে বসলেন। রামসুন্দরের অনুরোধে কান দিলেন না। এই সংকটে অভাবিতভাবে পাত্র নিজে পিতার অবাধ্য হয়ে বসলো। পিতার অমতে একরকম স্বেচ্ছায় নিরুপমাকে বিয়ে করল। সবাই বুঝলো, এর ফল ভালো হবে না।

বিয়ের পর নিরুপমাকে বাবা মায়ের কাছে রেখে তার স্বামী কর্মস্থলে ফিরে গেলেন। এবারের শ্বশুরবাড়ি দিন দিন জতুগৃহ হয়ে উঠতে লাগলো। মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে এলে রামসুন্দর বাইরের ঘরে কোনদিন মেয়ের দেখা পায়, কোনদিন হয়তো দেখা না পেয়ে ফিরে যেতে হয়। পণের 6-7 হাজার টাকা দেওয়া হয়নি বলে রায় বাহাদুর এই সম্পর্ককে স্বীকার করতে চান না। একবার ধার করে 2-3 হাজার টাকা দিতে এসে রামসুন্দর বেশ অপমানিত হয়ে ফিরে গিয়েছিল। রামসুন্দর বুঝেছে, পুরো টাকা না দেওয়া পর্যন্ত নিরুপমাকে সে নিজের গৃহে নিয়ে আসার অনুমতি পাবে না। অসহায় স্নেহময় পিতার মর্মযন্ত্রণা দু-একটি রেখায় লেখক মূর্ত করে তুলেছেন।

এদিকে সুচতুর শাশুড়ি নিরুপমার উপর নির্মম মানসিক কিরণ করে চলেছেন। নববধূ যেন তাদের গৃহে অনধিকার প্রবেশ করেছে। শাশুড়ির প্রশ্রয়প্রাপ্ত বাড়ির দাস-দাসীরা তাকে কৃপার চোখে দেখে। সকলের নিদারুণ উপেক্ষায় ও বিরূপতায় এই বন্দিদশা তার পক্ষে দুঃসহ হয়ে ওঠে। সে নিয়মিত আহারাদি করে না। তীব্র মানসিক কষ্টে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। বুদ্ধিমতী শাশুড়ি বধূর অসুস্থতাকে নিছক সাজানো ভান সাব্যস্ত করলেন। সুতরাং নিরুপমা শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেও তার চিকিৎসার কোন প্রশ্ন উঠল না।

শ্বশুর বাড়িতে মেয়ের এই নির্যাতন রামসুন্দরকে উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত করে তুলল। মেয়ের দুঃখ ঘোচাতে রামসুন্দর গোপনে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করতে লাগলো। নিজের বসত বাড়ি বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করল। তারপর, পণের বাকি টাকা নিয়ে রায়বাহাদুরের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হল। রামসুন্দরের বড় আশা, এবার অন্তত কিছু দিনের জন্য মেয়েকে নিজের কাছে এনে রাখতে পারবে। কিন্তু সত্য গোপন থাকলো না। বাড়ি বিক্রির কথা জেনে দাদারা একেবারে ভেঙে পড়ল। তারা রামসুন্দরকে অনেক বাধা দেবার অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু ফল কিছু হলো না। সমস্ত পরিবারটিকে নিরাশ্রয় করতে বাধা দিল নিরুপমা। সে স্পষ্ট বলল, সে এই বাড়ির বধূ, টাকার থলি মাত্র নয়। অর্থের বিনিময়ে তার প্রাণের মূল্য নির্ধারিত হতে পারে না। মেয়ের যুক্তির কাছে হার মেনে ফিরে গেল রামসুন্দর।

এই সংবাদ গোপন থাকলো না। দাসীদের মাধ্যমে শাশুড়ির কানে তা পৌঁছে গেল। শুরু হলো নিদারুণ উৎপীড়ন। নিরুপমার রোগ বেড়ে চলল। শেষে সত্যই একদিন রায় বাড়িতে ডাক্তার ডাকা হল, সেই প্রথম এবং সেই শেষ। চিকিৎসার কোনো সুযোগ না দিয়ে নিরুপমার অকাল মৃত্যু ঘটলো। পরে অবশ্য, রায়বাড়ির যথোচিত মর্যাদা রেখে মহা ধুমধামের সঙ্গে এ-বাড়ির বধুর অন্তেষ্টি ক্রিয়া সুসম্পন্ন করা হয়েছিল। জীবিতকে যতই লাঞ্ছনা করা হোক, মৃতের প্রতি অমর্যাদা শাস্ত্রবিরুদ্ধ মহাপাপ। গল্পের উপসংহার এই ভয়ঙ্কর সমাজ সমস্যার কদর্য রূপটি উদঘাটিত হয়েছে। নিরুপমা স্বামী নতুন সংসার পাতার জন্য স্ত্রীকে তার কাছে পাঠিয়ে দেবার জন্য বাড়িতে চিঠি দিয়েছিল। উত্তরে নিরুপমার শাশুড়ি জানিয়েছিল, ” এবারে বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায়।” এই শেষ বাক্যে পণপ্রথার বিরুদ্ধে লেখকঃ রবীন্দ্রনাথের বিদ্রূপ ও শৈল্পিক প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Why national building regulations. » »  pen city. General dm developments north west.