Q: কৈশোরকাল | কৈশোরকালের বিকাশগত বৈশিষ্ট্য, চাহিদা |
Q: কৈশােরকালের বিকাশগত বৈশিষ্ট্য গুলি আলােচনা কর।
Q: কৈশােরকালে কি কি চাহিদা দেখা যায় তা বিস্তারিত ভাবে আলােচনা কর।
Q: কৈশােরকালে শিশুর মধ্যে কি কি মানসিক চাহিদা দেখা যায় তা আলােচনা কর।
Q: কৈশােরকালের সামাজিক চাহিদা গুলি কি কি তা উল্লেখ করো।
Q: কোন সময়কালকে ঝড় ঝঝার কাল বলা হয়?
কৈশােরকাল বা যৌবনাগম
মনােবিজ্ঞানীদের ভাষায় শিশুর জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ স্তর হল কৈশােরকাল।12 থেকে 18 বছর ব্যস কালকে কৈশােরকাল বা যৌবনাগম বলে। কৈশাের কালের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল ‘adolescence’ এটি ল্যাটিন শব্দ ‘adolescere’ থেকে এসেছে যার অর্থ হল ‘পরিণমনের পথে বিকাশ’ (to grow into maturity) এই স্তরে শিশুর দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক দিক থেকে পরিপূর্ণতা আসে। কৈশাের কালের শিক্ষা স্তর হল নিম্ন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক কৈশাের কাল এর পরেই শুরু হয় প্রাপ্তবয়স্ক কাল। কোন কোন মনােবিজ্ঞানী এই স্তরকে শৈশবের পুনরাবৃত্তি কাল বলে মনে করেন। এই সময় শিশুর দেহ ও মনের মধ্যে যে অভূতপূর্ণ পরিবর্তন আসে তার ফলে জীবন-জগৎ সম্বন্ধে। নানা প্রশ্ন তাদের মনে দেখা যায়, নানা মানসিক দ্বন্দের সম্মুখীন হয় তাই মনােবিজ্ঞানী স্ট্যানলি হল কৈশাের কালকে ‘ঝঞ্ঝার কাল’ হিসেবে বলেছেন।
কৈশােরকালের বিকাশগত বৈশিষ্ট্য :
1) দৈহিক বিকাশ গত বৈশিষ্ট্য :
- কৈশােরকালে দেহের বাহ্যিক কাঠামাে যেমন পরিবর্তন ঘটে তেমনি অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন উপাদানের পরিপূর্ণতা আছে।দৈহিক বৃদ্ধি এই সময় দ্রুতহারে ঘটে, দেহের পেশীগুলাে পরিপূর্ণতা লাভ করে।
- এইসময় মাংসপেশি দৃঢ়হয়,হাড়,গ্রন্থি, হৃদপিণ্ড প্রভৃতির বৃদ্ধি হয়।ওজন ও দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন হয়। মেয়েদের বৃদ্ধি ছেলেদের তুলনায় দ্রুত হয়। 14 বছরের পর সাধারণত ছেলেরা মেয়েদের থেকে দ্রুত লম্বা হয় এবং দেহ সবল হয়ে ওঠে।
- এই সময় মুখমণ্ডলের পরিবর্তন ঘটে। বিশেষত ছেলেদের মুখে কাঠিন্যের ছাপ পড়ে, মুখের মাংস পেশী দৃঢ় এবং উজ্জল হয়। মেয়েদের মুখ কোমল, লাবণ্যময় এবং গােলগাল হয়ে ওঠে।
- ছেলেদের গলার স্বরের পরিবর্তন হয়। দাড়ি-গোঁফ বের হয়।
- কৈশােরকালে রক্তসঞ্চালন, স্বাস-প্রশ্বাস ও পাকস্থলির কাজকর্ম বৃদ্ধি পায়। খিদে বাড়ে, দৈহিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।অন্তক্ষরা গ্রন্থি থেকে রস নির্গত হওয়ার ফলে কিশাের-কিশােরীদের মধ্যে যৌন উত্তেজনা অনুভূত হয়।
2) মানসিক বিকাশগত বৈশিষ্ট্য ( Characteristic of mental Development) :
• মানসিক দিক থেকেও এই সময় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এই পরিবর্তনের হার শৈশবের চেয়ে অনেক বেশি। চিন্তাশক্তি, কল্পনাশক্তি তীব্র মাত্রায় হয়। যুক্তি এবং বিচার-বিশ্লেষণ ক্ষমতা প্রবল হয় হওয়ার দরুন যেকোনাে ধরনের সমস্যা স্বাধীনভাবে সমাধানের চেষ্টা করে।
• প্রক্ষোভিক আচরণের পরিবর্তন দেখা যায়। কখনাে আনন্দে মাতােয়ারা আবার কখনাে দেখায়।হীনমন্যতা, হতাশা, অন্তর্দ্বন্দ্ব এই সময় দেখা যায়।অপরাধবােধ, লজ্জাভাব ভয় প্রভৃতি প্রক্ষোভ গুলি যৌন আচরণের পরীক্ষিতের নতুন রূপ ধারণ করে সমস্যা সৃষ্টি করে।
নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পােশাক-পরিচ্ছদ, চলাফেরা, কথাবার্তা, মেলামেশা প্রভৃতি। আচরণের পরিবর্তন ঘটে এইসব আচরণের মধ্যেদিয়ে নিজেদের বিশেষত্ব দেখানাের চেষ্টা করে।
3) সামাজিক বিকাশ গত বৈশিষ্ট্য :
- সামাজিক দিক থেকে কৈশাের কালে নীতিবােধ, সামাজিক দায়িত্ববােধ ইত্যাদি ধারণা গড়ে ওঠে।
- নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার, কোন কিছুর সৃষ্টি করার , সব কাজে বীরত্ব দেখানাে, ও অন্যের প্রশংসা পাওয়ার তীব্র তাড়নাদেখা যায় ।
- বাইরের জগতের প্রতি ও সমাজের প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে ফলে জনকল্যাণমূলক কাজের প্রতি প্রবণতা দেখা যায়। দল গঠন করে। এই সময় ছেলে-মেয়েরা চিন্তাশীল ও আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে।
- এই সময় ছেলে এবং মেয়েরা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে।
- এই বয়সে ছেলে-মেয়েরা আবেগের বসে অনেক সময় নানা দুঃসাহসিক কাজ বা আত্মদানের মত কাজ করে থাকে। এই সকল কাজ মূলত আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়।
- এই বয়সে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সৌন্দর্যবােধ খুব প্রবল হয়।
কৈশাের কালের চাহিদা (Needs of Adolescence) :
কৈশােরকালের চাহিদাগুলিকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়– দৈহিক চাহিদা ,মনােবৈজ্ঞানিক চাহিদা ও সামাজিক চাহিদা।
1) দৈহিক চাহিদা (Physical Need) :
কৈশাের কালের বালক-বালিকাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের চাহিদা দেখা যায়। তার মধ্যে প্রধান হল খাদ্যের চাহিদা ও যৌন চাহিদা।
a) খাদ্যের চাহিদা (Need for food)- কৈশাের কালের দৈহিক পরিণমনের ফলে দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কাজকর্ম বেড়ে যায়, ফলে খাদ্যের চাহিদা প্রবল মাত্রায় দেখা যায়। তাই কিছু সময় অন্তর অন্তর ছেলে-মেয়েরা প্রবল খিদে অনুভব করে। তাদের এই খাদ্যের চাহিদা মেটানাের জন্য বাবা-মা বা বয়স্করা বিরক্ত হয়ে যায়। এই সময় খাদ্যের চাহিদা যথাযথভাবে পরিপূর্ণ না হলে দৈহিক বিকাশ ব্যাহত হতে পারে।
b) যৌন চাহিদা (Sex-need) – দৈহিক দিক থেকে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিকাশের ফলে ও অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির পূর্ণ কার্যকারিতার ফলে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যৌন চাহিদা দেখা যায়। মেয়েরা ছেলেদের এবং ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গী হিসেবে পেতে চায়। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি মেলামেশার তাগিদ অনুভব করে। মানুষের জীবন সম্পর্কে নানা প্রশ্ন জেগে ওঠে তাদের মনে কিন্তু বিভিন্ন সামাজিক অনুশাসন এর ফলে তারা কৌতুহল সহজে মেটাতে পারেনা। এই চাহিদা পরিতৃপ্ত করার জন্য অনেক সময় বিভিন্ন অসামাজিক কাজ করে ফেলে।
2) মানসিক চাহিদা ( Psychological Need) :
এ সময় ছেলে মেয়েদের মধ্যে নানা ধরনের মানসিক চাহিদা দেখা যায় সেগুলি হল –
a) স্বাধীনতার চাহিদা (Need For Freedom)- শিশুরা বাল্যকাল পর্যন্ত পিতা-মাতা ও পরিবারের বয়স্কদের ওপর নির্ভরশীল থাকে কিন্তু কৈশােরকালে তারা স্বাধীনভাবে বিভিন্ন কাজ করতে চায়। স্বাধীনভাবে নিজের মতপ্রকাশ করে প্রকাশ করতে চায়। নিজেদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরতা থাকে। সেজন্য বাবা-মা বা বয়স্কদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে চায় না বা সহজে মেনে নিতে পারেনা।
b) নিরাপত্তার চাহিদা (Need for security) – কৈশােরকালে ছেলেমেযেদের মধ্যে নানারকম কাল্পনিক ভয় দেখা যায়। তারা ভাবে নিজেদের ইচ্ছামত কাজ করলে বয়স্করা তাদের উপর রেগে যাবে বা তাদের সঙ্গী সাথীরা তাদেরকে পরিত্যাগ করবে, শাস্তি দেবে। এসব ভয় তাদের মধ্যে কাল্পনিক আশঙ্কা তৈরি করে। তাই তারা বয়স্ক ব্যক্তি, বাবা-মা, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে নিরাপত্তা আশা করে। আর তা যদি না পায় তাহলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
c) আত্ম প্রকাশের চাহিদা (Need for self – expressions) – কৈশােরকালে ছেলেমেযেদের মধ্যে আত্মপ্রকাশের চাহিদা প্রবল মাত্রায় দেখা যায়। এই সময় তারা বিভিন্ন সামাজিক বা সাংস্কৃতিক কাজকর্ম যেমন-খেলাধুলা, ছবিআঁকা, গান, অভিনয় ইত্যাদির মধ্য দিয়ে নিজেকে সকলের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করে। অনেকসময় তাদের আত্মপ্রকাশের চাহিদা পূর্ণ না হলে এই চাহিদা পরিতৃপ্ত করার জন্য বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করে ফেলে।
d) জ্ঞানের চাহিদা ( Need for Knowledge ) – কৈশােরকালে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বুদ্ধির বিকাশ পরিপূর্ণতা লাভ করে। তাদের আগ্রহের বিষয়বস্তুকে জানার কৌতুহল বাড়ে। এই ইচ্ছা থেকে কোন বিষয়কে বিচার-বিশ্লেষণ করে তা থেকে নতুন তথ্য সংগ্রহ করে এবং তাদের জ্ঞানের চাহিদা পরিপূর্ণ করে। জ্ঞানের চাহিদা মেটানাের জন্য বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে থাকে। আবার অনেকসময় তাদের মধ্যে ভালাে-মন্দ বােধ ঠিকমত জাগ্রত না হওয়ার কারণে তারা এমন সব বই পড়ে যেগুলাে আদর প্রকৃত তথ্য ভিত্তিক নয়।
3) সামাজিক চাহিদা (Social need) :
কৈশাের কালের সামাজিক চাহিদাগুলি বিশেষ কতগুলি প্রবণতাকে কেন্দ্র করে লাভ করে। সামাজিক দিক থেকে তারা নিজেদেরকে অভিজ্ঞ বলে মনে করে থাকে। সামাজিক চাহিদা গুলি হল –
a) সামাজিক স্বীকৃতির চাহিদা ( Need for social acceptance ) – এই বয়সে ছেলেমেয়েদের মধ্যে সামাজিক স্বীকৃতির চাহিদা দেখা যায় বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সামাজিক অভিজ্ঞতা অর্জন করে। তারা চায় বয়স্করা তাদের কাজকে স্বীকৃতি দিক। এই চাহিদার তারণায় বিভিন্ন সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তারা তাদের মতামত পােষণ করে এবং তারা চায় তাদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া হােক। কিন্তু বয়স্করা তাদের এই কাজকে স্বীকৃতি না দিলে অনেক সময় তারা দলগতভাবে বিভিন্ন অসামাজিক কাজে যুক্ত হয়ে পড়ে।
b) নৈতিক চাহিদা (Moral Need) – কৈশােরকালে সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক প্রভাবে ছেলেমেয়েদের মধ্যে নীতিবােধ জাগ্রত হয়। এই নীতিবােধ কিশাের-কিশােরীদের আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করে এবং নিজেদের নৈতিক বােধ থেকে বয়স্কদের আচরণের মূল্যায়ন করার চেষ্টা করে।
c) দুঃসাহসিক অভিযানের চাহিদা( Need for Adventure) – কৈশােরকালে কৌতুহলের প্রবণতা প্রবল মাত্রায় দেখা যায়, সেজন্য তারা বিভিন্ন ধরনের দুঃসাহসিক কাজ করে থাকে। বয়স্কদের সামনে বা অন্যান্যদের সামনে নিজেদের গুরুত্ব বাড়ানাের জন্য বিভিন্ন দুঃসাহসিক কাজ করার প্রবণতা দেখা যায়। যার ফলে দৈহিক ক্ষতি হয়ে থাকে কখনাে কখনাে। এমনকি যৌন আচরণ গুলি কেউ সাহসিক কাজ বলে মনে করে এই চাহিদার তাগিদে তারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করে থাকে।