উনিশ শতকে বাংলা কবিতা বিহারীলাল চক্রবর্তীর হাতে যে অভিনবত্ব লাভ করেছিল তার পরিচয় দাও।

ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা কাব্য-সাহিত্যে বিহারীলাল চক্রবর্তী হলেন রোমান্টিক যুগের প্রবর্তক এবং গীতিকবি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘আত্মবিলাপ'(১৯৬১) ও ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ (১৮৬২) কবিতা দুটি বাদ দিলে বিহারীলালই প্রথম সার্থক গীতিকবি রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ হল ‘সংগীত শতক’, ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রকৃত কৃতিত্ব হল এই যে, তিনি মধুসূদন-এর যুগে কাব্য রচনা করেও মধুসূদনকে অনুসরণ করেননি।

 

বিহারীলাল জন্মেছিলেন কলকাতা জোড়াবাগান অঞ্চলে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর বংশের প্রকৃত উপাধি ছিল চট্টোপাধ্যায়। ফরাসডাঙ্গায়  ছিল তাঁদের আদি বাস। তাঁর ঠাকুরদা ছিলেন দ্বারকানাথ, বিদ্যাসাগরের সহপাঠী। বিহারীলালের পিতা দিননাথ সুবর্ণ বণিক সম্প্রদায় পৌরোহিত্য করে জীবনযাপন করতেন। চার বছর বয়সে তিনি তাঁর মাকে হারান। বাল্যকালে বিহারীলালের পড়াশোনায় বিশেষ মনোযোগ ছিল না। তাঁর পিতা ভাবতেন সামান্য সংস্কৃত শিক্ষা করলেই যজমান রক্ষা করতে পারবে তাঁর ছেলে। কৈশোরে কিছুদিন তিনি জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন অর্থাৎ স্কটিশ চার্জ কলেজে পড়াশোনা করেন। পরে তিন বছর তিনি সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৮৫৪ সালে তিনি তাঁর বাড়ির কাছে বসবাসকারী কালিদাস মুখোপাধ্যায়ের কন্যা অভয়াদেবীকে ১৯ বছর বয়সে বিয়ে করেন। বিয়ের চার বছর পর স্ত্রী গত হন। তিনি  ১৮৬০ সালে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। তাঁর পত্নীপ্রেমের কথা অনেক রচনায়ও ব্যক্ত হয়েছে।১৮৫৯ সালে বিহারীলাল ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। সেই সময় তাতে তাঁর অনেকগুলি কবিতা প্রকাশিত হয়। পরে ‘সাহিত্য সংক্রান্তি’ নামে একটি মাসিক পত্রিকায় আরো কতকগুলি কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৮৭০ সালে বিহারীলাল যখন সারদামঙ্গল লেখা শুরু করেন তখনই তাঁর পিতার স্বাস্থ্যভঙ্গ হয় এবং ১৮৭৫-এ তাঁর মৃত্যু হয়। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে ১৮৭৭ সালে তখন ‘ভারতী’ পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে, তার অনেক আগে থেকেই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও বন্ধুত্ব ঘটে। সেই সুবাদে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়। তবে থেকেই ঠাকুরবাড়িতে তাঁর যাতায়াত শুরু হয়। বিহারীলাল সম্বন্ধে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন, “যখন কোন সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা হয়েছে অথবা গম্ভীর বিষয়ে চিন্তা করিতেন, তখন তামাক টানিতে টানিতে তাঁহার চক্ষু দুইটি বুজিয়া আসিত, তিনি আত্মহারা হইয়া যাইতেন।” ‘সাধের আসন’ কাব্যটি তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরীদেবীর অনুরোধে রচনা করেছিলেন সে কথা ভূমিকায় স্বীকার করেছেন। ১৮৯৪ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে বিহারীলাল পরলোকগমন করেন। মৃত্যুর পর কবি অক্ষয় কুমার বড়াল যে শোকগীতি রচনা করেন তা বাংলা সাহিত্যে সুপরিচিত হয়ে আছে–

“এসেছিল শুধু গায়িতে প্রভাতী/না ফুটিতে উষা, না পোহাতে রাতি,/আঁধারে আলোকে প্রেমে মোহে গাথি”..

 

বিহারীলালের কাব্যকাল ১৮৫৮ থেকে১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। স্বপ্নদর্শন(১৮৫৮) তাঁর একটি প্রথম গদ্য রূপক কাব্য। পরবর্তীকালে তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলি হল-

সংগীত শতক (১৮৬২), বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০) নিসর্গ সন্দর্শন, বন্ধুবিয়োগ, প্রেম প্রবাহিনী প্রভৃতি ১৮৭০ সালেই প্রকাশিত হয়।

তিনি ‘সারদামঙ্গল’ কাব্য সমাপ্ত করেন১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে।এই কাব্য প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন–

“মৈত্রীবিরহ, প্রীতিবিরহ, সরস্বতীবিরহ, যুগপৎ ত্রিবিধ বিরহে উন্মত্তবৎ হইয়া আমি সারদামঙ্গল সংগীত রচনা করি।”

বিরহ ও মিলনের মধ্যে কবি বিরহকেই ভালোবাসেন, কারণ বিরহের মধ্য দিয়েই মানসলক্ষ্মীর বিচিত্ররূপিণী সত্তা প্রকাশ পেয়েছে। তাই তিনি তো কবিতায় বলেন-

“সে শোক- সংগীত কথা/শুনে কান্দে তরুলতা/তমসা আকুল হয়ে কাঁদে উভরায়।”

বিহারীলালের জীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না।তবে তাঁর বন্ধু কৃষ্ণগোপাল ভট্টাচার্যের স্মৃতিকথা থেকেই কিছু তথ্য পাওয়া যায়। বিহারীলাল ছিলেন দীর্ঘাকৃতি, তেজিয়ান ও অকুতোভয় ব্যক্তি । তিনি ছিলেন পিতার একমাত্র পুত্র। তাই তাঁর আবদার রক্ষার কারণেই তাঁর বাবা তাঁকে ১৯ টাকা দিয়ে ‘শকুন্তলা’ কিনে দিয়েছিলেন। ইংরেজি শেখার জন্য তিনি বায়রনের চাইল্ড হ্যারল্ড এবং শেক্সপিয়ারের ওথেলো, ম্যাকবেথ, কিং লিয়ার প্রভৃতি কয়েকটি নাটক একসঙ্গে পাঠ করেছিলেন। ভট্টাচার্যের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে, ইংরেজিতে পোপ ও তাঁর অনুগামী কবিদের পর ক্র্যাব, কাউপার, বাইরন প্রভৃতি কবিরা কবিতায় যে নতুনত্ব এনেছিলেন বিহারীলালের নতুনত্ব কিছুটা সেইরকম। তাঁর ‘সংগীত শতক’ একশটি গানের কালেকশন। সেগুলির মধ্যে একটি অপূর্বতা আছে। বিহারীলালের স্বভাব-চরিত্র ছিল অতি নির্মল।

 

বিহারীলালের রোমান্টিক কবি পরিচয় শুধু তাঁর দূরাভিসার বা বিষণ্ণতা নয় কিছুটা শুধু হৃদয়াবেগের দ্বারা চিহ্নিত এবং প্রকাশভঙ্গির বিশিষ্টতায় রোমান্টিক। কেউ কেউ তাঁকে ‘মিস্টিক কবি’ বলেও চিহ্নিত করেন। কিন্তু সারদামঙ্গলের সোনার শ্লোকগুলি সেই বিবিধ রূপের আভাস দেয় কিন্তু কোনও রূপকেই স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে পারে না। তাই রবীন্দ্রনাথ সারদামঙ্গল-এর  বিশ্বব্যাপী সৌন্দর্য লক্ষ্মীর ধারণার সঙ্গে শেলীর ‘স্পিরিট অফ বিউটি’র সাদৃশ্য লক্ষ করেছেন।  বিহারীলালের কৃতিত্ব এই যে, তিনি সারদার রূপকল্পনায় কায়া ও ছায়ার মিশ্রণে রূপ থেকে অরূপে যাতায়াত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়–

“সারদামঙ্গল কাব্যে সুদূর সৌন্দর্য স্বর্গ হইতে একটি অপূর্ব পূরবী রাগিনী প্রবাহিত হইয়া অন্তরাত্মাকে ব্যাকুল গড়িয়া তুলিতে থাকে।”

 

সেই কারণে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ছদ্মমহাকাব্যের যুগে বিহারীলাল-এর আবির্ভাব অনেকটাই আকস্মিক এবং গীতিকবি রূপে মাইকেল মধুসূদন -এর পরবর্তী সময়ে তাঁর আবির্ভাব সময় ও কবিকে চিহ্নিত করে রাখে। তাঁর ত্রিবিধ বিরহের উন্মত্ততাই তাঁকে সে যুগের তুলনায় বিরল করেছে। আর বিরল বলেই বিহারীলাল আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Safety & security dm developments north west. Gpj nxtgen infrastructure private limited. Telugu songs lyrics.