ভূমিকাঃ হায়দার আলী যিনি কিনা স্বাধীন মহীশূর রাজ্যের প্রধান রূপকার ছিলেন। জীবনের প্রথমদিকে মহীশূর রাজ্যের প্রভাবশালী ব্যক্তি নঞ্জরাজের সামরিক বাহিনীতে অশ্বারোহী সৈনিক হিসেবে কাজ করতেন।একজন সাধারণ সৈনিক যাঁর বিদ্যাচর্চা বলতে তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু ছিল উদ্যম, সাহস এবং দৃঢ় মন। সালটি ১৭৪৯। মহীশূরের দেবানাল্লি নামে একটি স্থানে বন্দুক চালানোর প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। তরুণ সৈনিক হায়দার আলী সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম নঞ্জরাজের সুনজরে এলেন। নঞ্জরাজ হায়দারের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে পঞ্চাশটি ঘোড়া ও দুশো জনকে পরিচালনার ভার হায়দারের ওপর অর্পণ করেন। এরপর থেকে হায়দারের জীবনে একটানা উন্নতি ঘটতে থাকে। ১৭৫০-১৭৬০ সালের মধ্যে হায়দার আলি ক্ষমতার শিখরে পৌঁছে যান।
প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ (১৭৬৭-১৭৬৯ খ্রি:
১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে ভেরেলেস্ট ( ১৭৬৭-৬৯ খ্রিঃ ) গভর্নর হয়ে বাংলায় আসেন। এসময় ভারতে মারাঠা ও মহীশূর রাজ্য ছিল ইংরেজদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ভারতে ইংরেজ শক্তিরসম্প্রসারণের পথে প্রধান অন্তরায়। এ সময় মহীশূরে হায়দার আলি ( ১৭৬১-৮২ খ্রিঃ ) নামে একভাগ্যান্বেষী সৈনিকের উত্থান ঘটে। সাধারণ একজন সৈনিক হিসেবে জীবন শুরু করলেও নিজ প্রতিভাবলে তিনি মহীশূর রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন ( ১৭৬১ খ্রিঃ )। তার উত্থানে দাক্ষিণাত্যের অপর তিনশক্তি — ইংরেজ , মারাঠা, ওহায়দ্রাবাদের নিজাম, আতঙ্কিত হয়ে ওঠে এবং হায়দারের বিরুদ্ধে তারা একটি শক্তিজোট গঠন করে ( ১৭৬৬ খ্রিঃ )। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে হায়দার ইংরেজদের আশ্রিত কর্ণাটকের নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলে প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ ( ১৭৬৭-৬৯ খ্রিঃ ) শুরু হয়। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে হায়দার আলি অতর্কিতে বিশাল সেনাদল নিয়ে দাক্ষিণাত্যে ইংরেজদের প্রধান ঘাঁটি মাদ্রাজের উপকণ্ঠে হাজির হন। ইংরেজরা তখন হায়দার – প্রদত্ত শর্তে সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এই সন্ধি মাদ্রাজের সন্ধি ( ১৭৬৯ খ্রিঃ ) নামে পরিচিত।
দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ (১৭৮০-১৭৮৪ খ্রি:
১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর হয়ে ভারতে আসেন। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা মহীশূরের অন্তর্গত ফরাসি বাণিজ্যকেন্দ্র মাহে দখল করলে হায়দার ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। এইভাবে দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ ( ১৭৮০-৮৪ খ্রিঃ ) শুরু হয়।
যুদ্ধ চলাকালে হায়দার আলির মৃত্যু ঘটলে ( ১৭৮২ খ্রিঃ ), তার বীরপুত্র টিপুসুলতান ( ১৭৮২-৯৯খ্রিঃ ) বীর বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যান ।
১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ম্যাঙ্গালােরের সন্ধি দ্বারা দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশুর যুদ্ধের অবসান ঘটে এবং একে অন্যের অধিকৃত স্থানগুলি পরস্পরকে ফেরত দেয়। ওয়ারেন হেস্টিংস এই সন্ধিকে ‘ অপমানজনক শান্তি ’ (humiliating pacification ) বলে অভিহিত করেন।
তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ (১৭৯০-১৭৯২ খ্রি :
লর্ড কর্নওয়ালিস – এর আমলে ইঙ্গ-মহীশূর সম্পর্ক আবার তিক্ত হয়ে ওঠে। ইংরেজ ও মহীশূর – দু’পক্ষই জানত যে , ম্যাঙ্গালােরের সন্ধি সাময়িক যুদ্ধবিরতি মাত্র। এজন্য দু’পক্ষই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে টিপুসুলতান ইংরেজদের মিত্ররাজ্য ত্রিবাঙ্কুর আক্রমণ করলে তৃতীয় ইঙ্গ – মহীশূর যুদ্ধ শুরু হয়। নিজাম ও মারাঠারা ইংরেজ পক্ষে যােগদান করে। দুবছর ধরে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের পর ত্রি-শক্তি জোটের কাছে টিপু পরাজিত হন। তার রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তম অধিকৃত হয় এবং তিনি শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি ( ১৭৯২ খ্রিঃ ) স্বাক্ষরে বাধ্য হন।
চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ (১৭৯৯ খ্রি:)
লর্ড ওয়েলেসলির আমলে উল্লেখযােগ্য ঘটনা হল চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ। তিনি টিপু সুলতানকে অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বললে তিনি এই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এর ফলে চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ ( ১৭৯৯ খ্রিঃ ) শুরু হয়।
মহীশূর শার্দুল ’ টিপু সুলতান শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি মানতে পারেননি। এ কারণে তিনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। ইংরেজ ও নিজামের যুগ্মবাহিনী মহীশূর আক্রমণ করে ( ১৭৯৯ খ্রিঃ )। পর পর দুটি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে টিপু তার রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তমে আশ্রয় নেন।
শত্রুপক্ষ রাজধানী অবরােধ করে এবং তিনি যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। তার মৃত্যুতে স্বাধীন মহীশূর রাজ্যের পতন ঘটে এবং মহীশূরের একাংশে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এইভাবে ইংরেজরা ভারতে তাদের এক শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর হাত থেকে রক্ষা পায়।
জনৈক ঐতিহাসিকের মতে সামরিক , অথনৈতিক ও শান্তিকারী ব্যবস্থা হিসেবে মহীশূর জয় হল ক্লাইভের পরবর্তীকালে অর্জিত ইংরেজদের সর্বাধিক সাফল্য। এই যুদ্ধের ফলে ইংরেজরা এক প্রবল পরাক্রান্ত শত্রুর হাত থেকে অব্যাহতি পায় । ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের ক্ষেত্রে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজরা প্রথম বাধাটি অতিক্রম করে , শ্রীরঙ্গপত্তমের যুদ্ধে দ্বিতীয় বাধাটি অতিক্রান্ত হয়। ফরাসিরা ভারতে তাদের শেষ ও নির্ভরযােগ্য মিত্রের সহযােগিতা ও সাহায্য থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়।
টিপু সুলতানের পরাজয়ের কারণগুলি :
টিপু সুলতান বা মহীশূর রাজ্যের পতনের পশ্চাতে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল। যেমন –
দেশপ্রেমিক ও বীর যোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও পিতা হায়দার আলির বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি, কূটকৌশল ও বিচক্ষণতা পুত্র টিপু সুলতানের ছিল না। ইংরেজদের প্রতিরোধ করার জন্য দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য শক্তিগুলি থেকে ইংরেজদের বিচ্ছিন্ন করা অপরিহার্য ছিল। টিপু সুলতান এই ধরনের কূটনীতি প্রয়োগের কথা চিন্তা করেন নি।
(২) উপযুক্ত পর্যবেক্ষণের অভাব: টিপু সুলতান যুদ্ধ ও শাসনব্যবস্থার সব দিকে নিজেই নজর দিতেন। খুঁটিনাটি সব বিষয়ে নজর দিতে গিয়ে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি উপযুক্তভাবে নজর দিতে পারেন নি। এর ফল রাষ্ট্রের পক্ষে মঙ্গলজনক হয় নি।
(৩) দেশীয় শক্তির সাহায্য লাভে ব্যর্থ: ইংরেজরা টিপুর বিরুদ্ধে মারাঠা ও নিজামের সাহায্য পেয়েছিল। টিপু কিন্তু কোনও দেশীয় শক্তির সাহায্য পান নি। বলা হয় যে, টিপু যদি মারাঠা সাহায্য পেতেন, তাহলে যুদ্ধের ইতিহাস অন্যরকম হত। টিপু নির্ভর করেছিলেন ফরাসি সাহায্যের ওপর, যা বস্তুত কোনও উপকারেই আসেনি।
(৪) মনরোর অভিমত
ইংরেজ সেনাপতি মনরো বলেন যে, তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ-এর সময় লর্ড কর্ণওয়ালিস মারাঠা সাহায্য না পেলে যুদ্ধের ইতিহাস অন্যরকম হত।
(৫) সামগ্রিক নিরাপত্তার প্রতি অবহেলা
টিপু রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তমের নিরাপত্তার ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তাঁর রাজত্বের শেষ দিকে তিনি রাজধানী অবরোধ হওয়া সম্পর্কে অতিরিক্ত চিন্তিত হয়ে পড়েন। এর জন্য প্রয়োজনীয় সব মালপত্র তিনি রাজধানীতে গুদামজাত করেন। রাজধানীর নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে তিনি রাজ্যের সামগ্রিক নিরাপত্তার প্রতি অবহেলা করেন।
(৬) অশ্বারোহী বাহিনী হ্রাস
ইংরেজদের বিরুদ্ধে হায়দার আলির সাফল্যের মূলে ছিল তাঁর অশ্বারোহী বাহিনী। টিপু সুলতান অশ্বারোহী বাহিনীর সংখ্যা হ্রাস করে পদাতিক বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। এর ফল ভালো হয় নি। টিপুর আমলে ইংরেজরা একটি সুদক্ষ অশ্বারোহী বাহিনী গড়ে তুলে তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে এবং অপরপক্ষে, টিপুর পদাতিক বাহিনীও বন্দুক ও কামানে সজ্জিত ইংরেজ পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে পেরে ওঠে নি।
(৭) ইংরেজদের উন্নত রণকৌশল ও সামরিক দক্ষতা
সামগ্রিকভাবে ব্রিটিশ বাহিনীর রণকৌশল ও সামরিক দক্ষতা মহীশূরের বাহিনী অপেক্ষা অনেক উন্নত ছিল।
(৮) অপরাজেয় ইংরেজ শক্তি
ভারতের বৃহত্তর অংশ জয় করে ইংরেজ সেনাদল তখন একরকম অপরাজেয় হয়ে ওঠে। এই রকম একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বেশি দিন কারও পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়। টিপুর ক্ষেত্রেও অস্বাভাবিক কিছু হয় নি।
(৯) টিপুর আত্মরক্ষামূলক নীতি
হায়দার আলির নীতি ছিল আক্রমণাত্মক—তিনি সর্বদা ইংরেজদের চাপের মধ্যে রাখতেন। অপরপক্ষে, টিপুর নীতি ছিল আত্মরক্ষামূলক। এর ফলে ইংরেজরা সুবিধাজনক নীতি গ্রহণ করার সময় পেয়ে যেত।
(১০) যুদ্ধ নীতিতে ত্রুটি
চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধকালে তিনি যদি শ্রীরঙ্গপত্তম রক্ষার জন্য বসে না থেকে বরামহলের ওপর আক্রমণ হানতেন, তাহলে ইংরেজদের যাবতীয় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত, কিন্তু তিনি তা করেন নি।
(১১) মহীবুল হাসানের অভিমত
ঐতিহাসিক ডঃ মহীবুল হাসান বলেন যে, টিপু সুলতান যুদ্ধ অপেক্ষা শান্তির কৌশলেই অধিক উৎসাহী ছিলেন।
(১২) কর্মচারীদের ষড়যন্ত্র
সর্বশেষে বলা যায় যে, টিপুর কর্মচারীদের একটি অংশ তাঁর বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। এই সব কারণে মহীশূর রাজ্যের পতন অবশ্যম্ভাবী ছিল।
উপসংহার:-
হায়দার আলি যে শক্তিশালী মহীশূর রাজ্য গঠন করেছিলেন ইংরেজরা চারটি যুদ্ধের (প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ, দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ, তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ ও চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ) মাধ্যমে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে তার পতন ঘটায়।