আমার কৈফিয়ৎ” কবিতায় কবি নজরুল ইসলাম কি কোনো কিছুর কৈফিয়ৎ প্রদান করেছেন ? কবিতাটির বিষয়বস্তু আলোচনা করে তা স্পষ্ট করো। অথবা কাজী নজরুল ইসলামের ‘আমার কৈপিয়ৎ’ কবিতার নামরণের সার্থকতা আলোচনা করো।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতাটি ‘সর্বহারা’ কাব্যের একটি বিশিষ্ট কবিতা। কবিতার নামকরণ থেকে এটিই সহজে প্রতিপন্ন হয় যে কবি নিজের কাব্যসাধনা সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন। ‘কৈফিয়ৎ’ শব্দটি কোনো কিছুর অভিযোগ সম্পর্কে অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রত্যুত্তর।
কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি। সমকালীন রাষ্ট্রিক, সামাজিক, ধর্মনৈতিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বৈষম্য, শোষণ পীড়ন, বঞ্চনা দুর্দশা থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্ত করার জন্যে নজরুল ভাঙনের রৌদ্ররাগিণী তুলেছেন কবিতায়। সর্ববাপী পরাধীনতা ও বৈষম্যের জ্বালা কবিকে উন্মাদ, দুর্দম করে তুলেছে। তিনি তাই কালবৈশাখীর তাণ্ডবলীলায় অশান্ত বিক্ষুদ্ধ সোচ্চার। ভাবাবেগের তীব্রতায় তিনি বাঁধনহারা। সমসাময়িক সমাজ ও মানুষের দুর্দশাই তাঁর কাব্য প্রেরণার উৎস। এখানেই তিনি শাশ্বত জীবন ধর্মের বিচারে কিছুটা সীমাবদ্ধ এবং ভাবাবেগের আতিশয্যে শিল্পসিদ্ধির পরিমিতি সম্পর্কে সচেতন নন। তিনি বর্তমানের কবি—ভবিষ্যদ্রষ্টা ক্রান্তদর্শী কবি নন,—যুগের কবি হয়েও যুগধর্মের প্রগতিশীলতা সম্পর্কে বুঝতে চাননি—তিনি হুজুগের কবি। তাই নজরুলের কাব্যসাধনা নিয়ে কঠোর ব্যঙ্গবিদ্রূপ হয়েছে অনেক। শনিবারের চিঠির সজনীকান্ত দাস, কবি মোহিতলাল মজুমদার, অশোক চট্টোপাধ্যায় প্রমুখরা কোমর কষে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথও মাঝে মাঝে নজরুলকে ফরমায়েসী কবিতা লেখার জন্যে ‘তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছার’-কথা বলেছেন। নজরুল বীররসের কবি। নিজের দৃঢ় ব্যক্তিত্ব ও কাব্যসাধনার অভিপ্রায় সম্পর্কে সচেতন। দারিদ্র নিষ্পেষিত জনসমাজের মুক্তিই তাঁর লক্ষ্য। তাই তিনি অগ্নিবীণার কবি। কোনো বিরুদ্ধ সমালোচনা ও আঘাত তাঁকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে পারবে না। কবি ও অকবির অপবাদ তিনি নীরবে সহ্য করবেন। তিনি প্রকাশ্যে স্বার্থপর, অর্থলোলুপ, শোষণলিপ্সু, অত্যাচারী ভণ্ডদের মুখোশ খুলে দিতে চান। তিনি হাটে হাঁড়ি ভাঙবেন।

জনতার মুক্তির চান বলেই কবি সমকালীন রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সে শুধু মুক্তি আন্দোলনের যেটুকু ভালো সেটুকুর সমর্থনে প্রত্যক্ষত কোনও রাজনীতি করার অভিপ্রায় তাঁর ছিল না। তাই অহিংসবাদী, বিপ্লববাদী, স্বরাজীর দল সবাই তাকে ভুল বুঝেছে। তিনি আস্তিক্যবাদী না নাস্তিক্যবাদী এ নিয়েও অনেকের সংশয় ছিল। হিন্দু রমণীকে বিবাহ করার জন্যে হিন্দু মুসলিম দুই সম্প্রদায় বেশ ক্ষুণ্ণ ও তিতিবিরক্ত হন। নজরুল নারীজাতির সার্বিক মুক্তিকামী বলে তাঁকে নারীঘেঁষা কবি বলে অপবাদ সহ্য করতে হয়েছে। একদিকে যেমন বিদ্রূপ পরিহাসের ব্যঙ্গবাণ বর্ষিত হয়েছে অন্যদিকে ভক্তরা নজরুলকে নবযুগের কবির আখ্যা দিয়েছেন। নজরুলের বক্তব্যও তাই—তিনি নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের জাগরণে প্রভাতের ভৈরবী বাজিয়েছেন। তাঁর কবিতায় জনজাগরণের উদ্দীপনাশক্তি প্রচুর। ব্রিটিশ শাসনের অবসানকল্পে তাঁর কবিতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হয়েছে। এতে ভয় পেয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। নজরুলকে তারা জেলে পুরেছে—বহু গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করেছে। কবির সরসকৌতুক—দেশের কাব্য রসিকরা তাঁর কাব্যের মূল সুর বুঝতে দেশের ভণ্ড নেতারা আরও বেশি শয়তান। তারা দেশের স্বাধীনতা স্বরাজ আসার কথা বলে দেশের দরিদ্র মানুষের অর্থে স্বার্থসিদ্ধি করেছে।

স্বরাজের মোহে মূর্খ মানুষরা ক্ষুধার্ত ছেলেমেয়ের অন্ন মেরে স্বরাজের জন্যে চাঁদা দেয়। ‘ছেলে ক্ষুধায় কাঁদলে মা তাকে স্বরাজের লোভ দেখিয়ে চুপ করাতে চেষ্টা করে। স্বরাজের চোরাগুলি দিয়ে হাফ নেতারা দুপয়সা কামায়—ফুল নেতা হয়ে উঠে। নজরুল বাস্তব জীবনের পরিচয় রাখেন। কচি কচি ছেলেরা দুমুঠো নূন ভাত পায় না। অথচ নেতাদের কথায় হাজার হাজার পিতামাতা শিশুকে অনাহারে রেখে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে স্বরাজের চাঁদা দেয়। নেতাদের পকেটে কোটি কোটি টাকা চলে যায়।

দেশে দুর্ভিক্ষ মহামারী অনাহারে লক্ষ লক্ষ শিশুর মৃত্যু নজরুলকে দারুণ ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। তিনি একা সমস্ত দেশে ঘুরে ফিরে মানুষকে বিদ্রোহী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পারেন না। তাই জাতিকে সংঘবদ্ধভাবে শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্যে কাব্যকেই চেতনা সঞ্চারের মাধ্যম করে নিয়েছেন। যুগের হুজুগ কেটে গেলে কবি হিসেবে তিনি বেঁচে থাকবেন কি থাকবেন না—তার পরোয়া করেন না নজরুল। অসহায় দরিদ্র তেত্রিশ কোটি মানুষের অন্ন যারা কেড়ে খায় কবি তাদের সর্বনাশ চান।

কবিতাটির মূল ভাব বিদ্রোহী। অঙ্গীরস হচ্ছে বীর রস। সহকারী রস হিসাবে হাস্যরসের বিচিত্র অভিব্যক্তি ঘটেছে। একে এক কথায় কৌতুক রস বলা হয়। এতে আক্রমণ নেই, আঘাত নেই কারুর প্রতি। বরং বিরুদ্ধবাদীদের আক্রমণ সরস কৌতুকে কবি উপভোগ করেছেন। রসসৃষ্টির প্রয়োজনে কিছু কথা কবিকে বানিয়ে নিতে হয়েছে। শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাসকে প্রেয়সী বলা, দাড়ি চাঁছা, হাড়ি চাঁছা, আড়ি চাচা, মৌলভী যত মৌলবি, আমপারা-হামবড়া, আনকোরা, নন্ ভায়োলেন্ট, ভায়োলেন্সের ভায়োলীন, গোঁড়ারাম—পাতিরাম স্বরাজী নারাজী প্রভৃতি অর্থগূঢ় শব্দ প্রয়োগে হাস্যরসের ঝিলিমিলি তরঙ্গ উঠেছে। সেগুলি বেশ উপভোগ্য এবং শিল্পগুণেও চমৎকার।

আদালতে অভিযুক্ত ব্যক্তি অর্থাৎ আসামীকে বিচারক আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেন। নজরুল তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের কৈফিয়ৎ দিয়েছেন। কবির অকপট সত্যভাষণে দৃঢ়তা প্রশংসনীয়—তিনি বর্তমান কালের শোষিত ক্ষুধার্ত অসহায় মানুষের মুক্তির প্রয়াসে বিপ্লবের বাণী বাহক সৈনিক। কাব্যই তাঁর তরবারি। চিরকালের অমরকবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের আকাঙ্ক্ষা তাঁর নেই। তিনি তেত্রিশ কোটি জনসাধারণের মুক্তি চান। স্বার্থপরায়ণ মুখোশধারী ভণ্ড দেশপ্রেমিকদের শাস্তি চান—সর্বনাশ চান। অন্যায় যারা করছে তাদের তিনি তৃণসম দগ্ধ করতে চান। ‘আমার কৈফিয়ৎ’—কবিতায় আছে আমার অর্থাৎ নজরুলের আত্মস্বরূপের বর্ণনা—যার মধ্যে তাঁর কাব্যসাধনার মূলগত অভিপ্রায়টি অভিব্যক্ত। প্রতিবাদীদের অভিযোগকে তিনি সানন্দে স্বীকার করে নিয়েছে—“কবি ও অকবি যাহা বল মোরে মুখ বুজে তাই সই সবি,”—বড়ো কথা বড়ো ভাব আসে না’ক পরোয়া করি না, বাঁচি কি না বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেল। অত্যাচারীর বিরুদ্ধেই কবির বৈনাশকী সংগ্রাম। “তাই প্রার্থনা করো—যারা কেড়ে খায়, তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস/যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ।” ‘আমার কৈফিয়ৎ’—কবিতার মধ্যে নজরুল তাঁর কাব্য সাধনার মূলগত অভিপ্রায় বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি উচ্চাঙ্গ শিল্পসৌকর্যের কবি না হতে পারেন—কিন্তু মানুষের মুক্তিদাতা শিল্পী যোদ্ধা। সেদিক থেকে নামকরণ সার্থক।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Building codes & building regulations part 2. My invoices explore your city. Tf header footer template dm developments north west.