আত্মহত্যার সংজ্ঞা :-
আত্মহত্যার সংজ্ঞা সহজসাধ্য নয়। বিভিন্ন দার্শনিকগণ এবিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ প্রকাশ করে থাকেন। যদি কোনো ব্যক্তি মানসিক বিকৃত প্রাপ্ত হয়ে বা রোগে জরাজীর্ণ হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়, তবে সেই ব্যক্তির আত্মহত্যার বিষয়টি অনেক সময় দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ধরা হয় না। কিন্তু যদি কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় বা লঘু কোনো কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। তবে সেক্ষেত্রে আত্মহত্যাকে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গ্রহণ করা হয় এবং শাস্তি হিসেবে সেই ব্যক্তির সম্পত্তি থেকে অর্থদণ্ড আদায় করে নেওয়া হয়। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে এই জাতীয় আইনের প্রয়োগ দেখা যায়।
আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ :-
আত্মহত্যার বহুবিধ কারণ রয়েছে। সাধারণত একটি নির্দিষ্ট কারণে আত্মহত্যা সংঘটিত হয় না। কারণগুলি এভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে—
(1) মানুষ যখন অসুস্থ অবস্থায় দীর্ঘদিন থাকে: তখন তার মধ্যে বেঁচে থাকার কোন স্পৃহা আর থাকে না। এই অবস্থায় সেই ব্যক্তির স্বাভাবিকত্ব ক্ষুণ্ণ হয়। তার মধ্যে দেখা যায় হতাশা ও নিরাশা। তার কাছে বেঁচে থাকা যন্ত্রণাময় হয়ে উঠে। এই অবস্থায় সেই ব্যক্তি তখন আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
(2) আত্মহত্যার আর একটি কারণ হল: জীবনের ব্যর্থতা। মানুষ যে কোন কাজে ব্যর্থ হলে মনের দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে সেই কাজটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়া আবশ্যক। জীবনের সঙ্গে সেই বিষয়টির সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। সাধারণত প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা ও ব্যর্থ প্রেমের হতাশায় মানুষ এভাবেই আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
(3) আত্মহত্যার আর একটি কারণ হল: দারিদ্র্য। পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলিতে এ জাতীয় আত্মহত্যার উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয়। অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষ দারিদ্র্যের কবলে পড়ে। এই অবস্থায় মানুষ বিষাদে ও হতাশায় পতিত হয়। বেঁচে থাকার জন্য ভয়ঙ্কর সংগ্রামে ধীরে ধীরে মানুষ পরাজিত হয়। এই অবস্থায় আত্মহননের পথ ছাড়া বা আত্মহত্যার পথ ছাড়া ব্যক্তির কোনো উপায় থাকে না।
(4) অনেক সময় মানুষ বা ব্যক্তির স্বপ্নভঙ্গ হলে ব্যক্তির জীবনে নিরাশা ও হতাশার গ্লানি পরিলক্ষিত হয়। এই স্বপ্নভঙ্গ মানুষের জীবনে বেদনা বহন করে আনে। এই অবস্থায় মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
আত্মহত্যা সম্পর্কে পণ্ডিত অ্যারিস্টালর অভিমত :-
অ্যারিস্টটল জীবনের প্রথম পর্বে আত্মহত্যার বিপক্ষে ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, মানসিক যন্ত্রণা, দারিদ্র্য ও অভাবের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য যারা আত্মহত্যা করে, তারা ভীরু এবং কাপুরুষ। তবে অ্যারিষ্টটল শেষ পর্যন্ত তার এই তত্ত্বকে বা আদর্শকে বাস্তবিত করতে পারেন নি।
আত্মহত্যা সম্পর্কে সক্রেটিসের অভিমত :-
সক্রেটিস ছিলেন একজন প্রখ্যাত দার্শনিক। তিনি জীবনের প্রথম স্তরে আত্মহত্যা সম্পর্কে তেমন কোন অভিমত প্রকাশ করেন নি। অর্থাৎ সক্রেটিস ছিলেন। আত্মহত্যার বিরোধী। তিনি মানুষকে ঈশ্বরের সম্পত্তি বলে মনে করতেন। তাই তিনি একথা প্রচার করতেন যে, জীবনের বন্দিশালা থেকে মানুষকে পালিয়ে যাওয়া উচিত নয়। তবে জীবনের শেষ পর্বে সক্রেটিস আত্মহত্যা সম্পর্কে ভিন্ন আদর্শের কথা অজ্ঞাতসারে প্রকাশ করেছেন। তাই বিষপান করাকে তিনি বিধাতা বিধান বলে মনে করতেন। যদিও তিনি স্বয়ং বিষপান করেই আত্মহত্য করেছিলেন।
আত্মহত্যার নৈতিক ও অনৈতিক দিক :-
পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ আত্মহত্যা সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। প্রাচীন গ্রীক ও রোমানদের মধ্যে আত্মহত্যাকে নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কেউ কেউ আত্মহত্যাকে বিধাতার নির্দেশ বলে মনে করতেন। আবার কেউ কেউ এই মতের বিরোধিতা করেছেন। সাধারণত নৈতিক অপরাধ বলেই আত্মহত্যার বিষয়টি বিবেচিত হয়েছে। পৃথিবীর কোন দেশ আত্মহত্যাকে অনৈতিক অপরাধ বলে স্বীকার করে না। সাধারণত একে নৈতিক অপরাধ বলেই চিহ্নিত করা হয়েছে। সুতরাং আত্মহত্যা যে একটি নৈতিক অপরাধ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
সপক্ষে ও বিপক্ষে মতামত :-
স্বেচ্ছামৃত্যু বা আত্মাহত্যা গ্রহণযোগ্য কিনা সে সম্পর্কে দুটি মতাদর্শ গড়ে উঠেছে। এক শ্রেণীর মানুষ মনে করেন, স্বেচ্ছামৃত্যু গ্রহণযোগ্য। কেননা এতে কষ্টের লাঘব হয়। পাশাপাশি আর এক শ্রেণীর মানুষ মনে করেন স্বেচ্ছামৃত্যু গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা মানুষের জন্ম বার বার হয় না। সুতরাং জীবনকে হত্যা করা ঠিক নয়। বর্তমান কালে পৃথিবীর সর্বত্র এই বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। এখনও বেশিরভাগ মানুষ স্বেচ্ছামৃত্যুর বিপক্ষেই মতামত দিয়েছে। এজন্য আমিও মনে করি স্বেচ্ছামৃত্যু বা আত্মাহত্যা গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থাৎ এর বিপক্ষেই অভিমত রয়েছে।